সুপ্রিয় দেবরায় »
গ্রামের মাঝখানে একটি বিশাল শিমুলগাছ। ফাল্গুন মাসে আগুনে রাঙা লালরঙের ফুলে ভরে থাকে গাছটি। এখন শিমুলফুলের ভিতরে জন্মানো মোচা ফেটে ছড়িয়ে পড়েছে শিমুলতুলো। বোশেখ মাসের তপ্ত হাওয়ায় উড়ছে এদিক-ওদিক। গাছের তলায় পড়ে থাকে তুলোর পি-গুলি।
গাছটির নামানুসারে গ্রামটির নাম হয় শিমুলতলা। অনেকে বলে শিমুল গাঁ। এই নামেই পরিচিতি সর্বাধিক।
রেলগাড়ির লাইনের মতন গাঁয়ের আঁকাবাঁকা মেঠোপথ চলে গেছে দিগন্ত ছাড়িয়ে। ধু ধু ফসলের মাঠে সবুজের মিছিল। তারই পাশ দিয়ে চলেছে একটি মানুষের মিছিল। জনাতিরিশেক হবে। সবার আগে বিশু। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে তপু আর মদন। কৃষ্ণকলির বন্ধু এরা। সেই ন্যাংটা বয়স থেকে। কতই বা বয়স এদের। পনেরো মতন হবে। পথের ধারে দাঁড়ানো উৎসুক জনতা দলবেঁধে দেখছে মিছিলকে। কারুর মুখে নেই কোনো সেøাগান অথবা গলা ফাটিয়ে চিৎকার। একটি নিস্তব্ধ-নীরবতার মিছিল। পথের ধারে দাঁড়ানো মা-বোনেরা, বাবারা অনেকেই এসে মিশে যাচ্ছে মিছিলের ভিড়ে। হয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মিছিলের লাইনটি। ধানের খেতের সদ্যগজানো চারাগুলোÑ যারা সবে মাথা তুলতে শুরু করেছে, তারাও যেন দলবেঁধে দেখছে এই নীরব মিছিলকে। খেতের জলকাদামাখা হাতে অসংখ্য কৃষ্ণকলি উদগ্রীব চোখে নত মাথাটি একটু তুলে চেয়েই আছে এই মিছিলের দিকে। কারুর-কারুর হাতে ধরা কাস্তে থেকে ঝরে পড়ছে ভেজা ঝুরো মাটি। শিমুলগাছের তলা দিয়ে নীরব মিছিলটি যাওয়ার সময় যেন মনে হচ্ছে, বিশু এবং অন্যান্য মিছিলধারীদের গম্ভীর থমথমে মুখগুলি থেকে বেরিয়ে আসছে তাদের ভিতরের জম ক্রোধ, রাগ এবং তার সাথে হতাশা আর বেদনা। যেন শিমুলফুলের কলা ফেটে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য তুলোর মতো কৃষ্ণকলিরা। আকাশ-বাতাস মুখরিত করে জানাচ্ছে তাদের মনের ক্ষোভ, হতাশা, বেদনা। চাইছে তারা একটি নির্ভরতা, নিরাপদ আশ্রয়। যেমন একজন কারিগর তপ্ত সূর্যের ছ্যাঁকা বাঁচিয়ে শিমুল তুলোগুলিকে পরম মমতায় আশ্রয় দেয় লেপ-তোশকের অন্দরে।
মাঠের বুকে, গায়ের আঁকাবাঁকা মেঠোপথে, শিমুলগাছের তলায় রেখে যায় চিহ্ন শিমুলতলা গাঁয়ের কন্যা কৃষ্ণকলির আলতা রাঙানো পা। রিমঝিম বৃষ্টির ধ্বনিতে নৃত্য করে সবুজঘাস কৃষ্ণকলির পায়ের নূপুরের স্পর্শে। চঞ্চলা কুমারী কৃষ্ণকলি হেসেখেলে-নেচে বেড়ায় গ্রামের বাগানে, মাঠে, পথে। তার তিন বাল্যবন্ধু বিশু, তপু আর মদনের সাথে। তারা তার স্কুলসাথীও। পড়ে নবম শ্রেণিতে। যায় এক সাথে বেথুয়াহাটি হাইস্কুলে, পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে। শিমুলগাছের তলা থেকে যে সরু মেঠোপথটি এগিয়ে চলেছে আমবাগানের দিকে, একটু এগোলেই সেই মেঠোপথের দুধারে বুজকাঁটার ঝোপ। বুজকাঁটা ছাড়াও পথের দুপাশে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে অড়হর-শেয়াকুল-আকন্দ-বাবলা-জগডুমুর-খেজুর-তাল-নারিকেলসহ বহু বৃক্ষ। মেঠোপথটি এসে এরপর ধাক্কা খায় একটি বিশাল আমবাগানে। এক পাশে একটি ডোবার মতো ছোট্টপুকুর। এই আমবাগানটির মালিক গ্রামের সবচেয়ে ধনী প্রতাপশালী ব্যক্তি প্রতাপ সিকদার। গ্রামের ৪০ ভাগ ধানীজমিও ওনার। বাকি ধানীজমিগুলির মালিক হালদার মশাই আর গুপ্তবাবু। খুব অল্প জমিরই নিজস্ব মালিক কয়েকটি হাতেগোনা কৃষক। বাকিরা সব চাষ করে সিকদার বাবু অথবা হালদার বাবু কিংবা গুপ্তবাবুর জমিতে ভূমিহীন চাষি হিসেবে। কৃষ্ণকলি আর তার বন্ধুদের প্রিয় খেলার জায়গা হচ্ছে সিকদার বাবুর আমবাগান। এখানে খেলে তারা চোর-পুলিশ, গুলি-ডান্ডা, মার্বেল, লাগোড়ি কিংবা পিঠু। কৃষ্ণকলি ছোট বয়স থেকেই ছিল বেশ ডানপিটে। তরতর করে উঠে যায় পেয়ারা অথবা আমগাছে। খেলতে ভালোবাসে গুলি-ডান্ডা অথবা মার্বেল তার ছেলেবন্ধুদের সাথে।
গায়ের রং শ্যামা হলেও বলা যায় ভেতরে রোদ নয়, যেন আগুনই ঝরছে। উজ্জ্বল মুখ, পানপাতার আকারে। ভাসা-ভাসা কালো চোখ। বয়সের তুলনায় একটু ডাগর-ডাগর চেহারা।
তপু একবার জিজ্ঞেস করেছিল, এই কলি, তুই যে আমাদের সাথে খেলিস-মিশিস, তোর বাড়ি থেকে আপত্তি করে না ?
কৃষ্ণকলি উত্তর দেয়, কেন? আপত্তি করবে কেন ?
না, মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। এখন তুই বড় হচ্ছিস। শাড়ি পড়ছিস।
তাতে কী হয়েছে ? তোরা আমার আজকের বন্ধু নাকি!
যদি কেউ ভাবে, আমরা তোকে এই আমবাগানে নিয়ে এসে প্রেম করছি। আমরা বড় হচ্ছি, প্রেম তো করতেই পারি।
এক থাপ্পড় খাবি। আমার সামনে এসে দেখ না কোনো বদমতলব নিয়ে। তোর নাক-মুখ ছিলে রক্ত বের করে দেব। বুঝবি তখন প্রেম করা।
বিশু তখন হেসে বলে, নারে কলি। আমাদের কারুর সাহস নেই তোর সাথে প্রেম করার। আমরা বন্ধু হয়েই থাকবো সারাজীবন। আর একটা কথা কী জানিস, কলি। আমরা যখন হাফপ্যান্ট পরি আর তুই পরতিস ইজের তখন থেকে আমরা এক সাথে খেলেছি, পুকুরে স্নান করেছি, গাছে উঠেছি। এ ক্ষেত্রে বন্ধত্বটাই ভালো, প্রেম একদম মানায় না।
কৃষ্ণকলি তখন অস্থির হয়ে বলে, ছাড় তো তোর এই বড়দের মতো কথা, বিশে। চল, আমরা চোর-পুলিশ খেলি। আর একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে।
দরমার বেড়া। মাথায় ঝরঝরে টিনের চাল। যার ফুটো দিয়ে আসে সূর্যের আলো, বৃষ্টির জল। বর্ষায় কাহিল হয়ে পড়ে কৃষ্ণকলির মা বাটি রাখতে-রাখতে ঘরময় ছড়িয়ে। না হলে যে ভেসে যাবে মাটির মেঝে আর চৌকির ওপর রাখা চাদর আর কাঁথা। কৃষ্ণকলির বাবা মালিকের খেতে সারাদিন জনমজুর খেটে জোগাড় করতে পারে অতিকষ্টে হয়তো দুমুঠো চাল আর একটু ডাল। আর কৃষ্ণকলির মা বনবাদাড় আর পুকুর ঘেঁটে হয়তো পায় কয়েকটা হেলেঞ্চার ডাটি কিংবা কিছুটা কলমি শাক। কিন্তু তাও তারা তিনজনে আছে সুখে-শান্তিতে। মাত্র তিনটেই পরনের শাড়ি। তার মধ্যে একটা দিয়েছে কৃষ্ণকলিকে পরতে। মেয়ে বড় হচ্ছে। জামা পরলে লোকের লোভাতুর দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে শরীরের নানান ভাঁজে, খেয়াল করেছে কৃষ্ণকলির মা। আগে থেকেই বলে রেখেছে ওর বাপকে, এ বছরকার কৃষ্ণকলির জন্মদিনে দুটো শাড়ি কিনে দিতেই হবে মেয়ের জন্য। একটা স্বস্তি, কৃষ্ণকলির জন্য দিতে হয় না একটা টাকাও স্কুলে। বচ্ছর বচ্ছর প্রথম হয় যে সে। স্কুলের সাদা জামা- নীল ফ্রকটাও স্কুল থেকে দেয় বিনা পয়সায়। এইবার পাশ করে পরের ক্লাসে উঠলেই শাড়ি পরতে হবে। মেয়ে জানিয়েছে, এবার ও প্রথম হলে স্কুল বই-খাতার সাথে দুই সেট শাড়ি-ব্লাউজও দেবে। মায়ের আশা, আর কয়েকটা বছর প্রায় টেনেই এনেছে। মেয়েটা একবার স্কুলের বড়পাশটা দিতে পারলেই, পেয়ে যাবে একটা চাকরি শহরে। তারপর তাদের আর কি চিন্তা।
আগামীকাল কৃষ্ণকলির জন্মদিন। সকাল থেকেই ব্যস্ত কৃষ্ণকলির মা। কৃষ্ণকলির বাবা জানিয়েছে আজ সিকদার বাবু কিছু টাকা দেবেন। মাঠের থেকে ফেরার পথে বাজার থেকে কিনে আনবে মেয়ের জন্য দুটো শাড়ি, একটু ভালো দামি চাল। পায়েস বানানোর জন্য। রাজু গোয়ালার থেকে একসের দুধ নিয়ে রেখেছে। জ্বাল দিয়ে রেখেছে ঘন করে। চালটা নিয়ে আসলেই পায়েস বানিয়ে ফেলবে। কাল বাজার থেকে একটু মাংসও কিনে আনবে। কয়েক যুগ বোধ হয় হয়ে গেছে মেয়েটা মাছ-মাংস খায়নি।
মেয়েটা আমের পাতলা টক খেতে ভালোবাসে। স্কুল থেকে মেয়ে ফিরতেই তাকে বলে সিকদার বাবুর আমবাগান থেকে কয়েকটা কাঁচা আম পেড়ে আনতে। বাগান পাহারাদার মেয়ের চেনা। না করবে না। স্কুলের বই-খাতা রেখে, শাড়িটা পরেই বেরিয়ে পড়ে কৃষ্ণকলি আমপেড়ে আনতে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে কৃষ্ণকলি বেরিয়েছে। সন্ধ্যার আঁধার বাইরে চেপে বসেছে। অনেকবার ঘর-বার করেছে কৃষ্ণকলির মা চিন্তিত মুখে। কিন্তু মেয়ের দেখা নেই। আশেপাশের ঘর থেকে হ্যারিকেনের আলো এসে পড়েছে ইটপাতানো সামনের রাস্তার ওপর। এবার আর থাকতে না পেরে, সামনের দরজা হাট করে খুলে রেখে কয়েক ঘর পর বিশুর বাড়ি খোঁজ নিতে আসে। কৃষ্ণকলির বাবা মাঠ থেকে ফিরে স্নান করতে গেছে। বিশুর মা জানায়, বিশুও ফেরেনি এখনও। কৃষ্ণকলি এসেছিল বিকেলে বিশুকে ডাকতে। বললো আমপাড়তে যাবে। ছুটতে ছুটতে বাড়ি এসে জানায় কৃষ্ণকলির বাবাকে। কৃষ্ণকলির বাবা বলে, নিশ্চয়ই আশেপাশে কারুর বাড়ি গেছে। তপু-মদনের বাড়িতে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি।
শুধু তপু-মদনের বাড়ি নয়। খোঁজা হলো গ্রামের ঘরে ঘরে, কোথাও হদিশ নেই কৃষ্ণকলি অথবা বিশুর। সবাই মিলে ছোটে আমবাগানের দিকে। কারুর হাতে টর্চ, কারুর হাতে হ্যারিকেন।
রক্তে ভেসে যাওয়া কৃষ্ণকলি, ব্যথায় কাতরাতে থাকা শিমুলগাঁয়ের কন্যা পড়ে আছে নির্জীবের মতন আমবাগানের জমিতে। কিছুদূরে অচৈতন্য বিশু। ঠোঁট-নাকের কাছে জমাটবাঁধা রক্ত। কপালে বড় কাটা দাগ।
শিমুলগাঁয়ের কন্যা মরণ কাতরানি কাতরাচ্ছে, বড্ড যন্ত্রণা মা। বিছানার চাদর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কৃষ্ণকলির বাবা, প্রতিবেশীরা ছুটে যায় গ্রামের একমাত্র ডাক্তার হরেন মুখুজ্জের বাড়ি। গ্রামের লোকরা অবশ্য জানে না- ডাক্তার বাবু পাশ করা ডাক্তার, নাকি কোয়াক। আপদে-বিপদে এই একজনই ডাক্তার গ্রামে। এই ডাক্তার হাল ছেড়ে দিলে ছোটে বেথুয়াহাটি শহরের হাসপাতালে। বিশুর জ্ঞান ফিরলে ওর মুখে শোনা কথায়, মেয়ে যে গণধর্ষণের শিকার- সে কথা ভয়ে-লজ্জায়, অপমানে ডাক্তারের কাছে বলার সাহস পায় না গ্রামের লোকেরা। গ্রামের লোকের বিবরণে ডাক্তার ভেবেছেন, স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত কোনো কারণে ব্যথা এবং রক্তপাত হচ্ছে। ডাক্তার নিজের হিসেবে ওষুধ দিয়ে দেন। যখন দরকার ছিল কৃষ্ণকলির অতি উন্নতমানের চিকিৎসা, তখন তার জোটে কোয়াক ডাক্তারের আন্দাজে দেওয়া ওষুধ। কিন্তু শিমুলগাঁয়ের শাসকদলের ছেলেদের ভয়ে, কৃষ্ণকলির প্রতিবেশীদের কারুর সাহস ছিল না সত্যিকথা জানানোর ডাক্তারকে অথবা কৃষ্ণকলিকে শহরতলীর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার। বিশুর মুখের থেকে যতটুকু তথ্য গ্রামের লোক শুনেছে, তাতেই তারা ভয়ে-ভয়ে আছেÑ কৃষ্ণকলির বাবার সাথে গ্রামের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল বলে। ওরা দেখেছে বাইক বাহিনী, কাপড় দিয়ে গোটা মুখ ঢেকে, হায়নার দৃষ্টিটা সরায়নি কৃষ্ণকলির বাড়ির থেকে। বাইক বাহিনীর চোখ এড়িয়ে, পিছন রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে ওরা পৌঁছেছিল ডাক্তার বাড়ি।
কোয়াক ডাক্তারের আন্দাজে দেওয়া ওষুধ বন্ধ করতে পারেনি কৃষ্ণকলির রক্তপাত আর ব্যথা। ‘বড় ব্যথা মা, আমি বোধ হয় আর বাঁচব না’ বলতে-বলতেই কন্যা ধীরে-ধীরে হয়ে পড়ে নির্জীব। খবর চলে আসে বাইক বাহিনীর কাছে, কান্নার রোল শুনে। খুশিতে উৎফুল্ল তারা। যেখানে মেয়েটা মরে পড়ে থাকার কথা আমবাগানে, কী প্রাণশক্তিরে বাবা মেয়েটার! এবার প্রাণপাখিটা উড়েছে বোধ হয়। আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। পঞ্চায়েতনেত্রী খুব রেগে আছেন এই দামাল ছেলেদের ওপর, যখন থেকে ঘটনাটা কানে গেছে ওনার। ওনার নির্দেশ, সব প্রমাণ-পত্র ছাই করে দিতে হবে নিমেষের মধ্যে।
প্রাণপাখিটি সত্যিই উড়েছে কী না, নিশ্চিত নয় তারা। ‘বড় ব্যথা মা’ শোনার পর আধঘণ্টা কেটে গেছে। আর দেরি না করে, শিমুলগাঁয়ের অভাগা কন্যার ক্ষতবিক্ষত শরীরটি চাদরে মুড়িয়ে বাঁশের ডগায় বেঁধে, কারুর অনুমতির তোয়াক্কা না করে বীরপুঙ্গবেরা বেরিয়ে পড়ে। কৃষ্ণকলির মা আশায় বুক বেঁধেছেন, নিশ্চয়ই এরা নির্জীব কৃষ্ণকলিকে নিয়ে যাচ্ছে শহরের হাসপাতালে।
কিন্তু এরা জানার চেষ্টা করে না কন্যাটি মৃত না সংজ্ঞহীন। কোনো প্রয়োজন মনে করে না পরীক্ষা করার একজন চিকিৎসককে দিয়ে। নিয়ে যায় একটি অননুমোদিত শ্মশানে। কোনো ডাক্তারের লিখিত মৃত্যুপত্র ছাড়া, কন্যার শরীরে তখনও প্রাণপাখি আছে কিনা সেটা জানার চেষ্টা না করে জ্বালিয়ে দেয় সব কুকীর্তির প্রমাণ। একজন ডাক্তারও মৃত্যুপত্র দেন, কোনো মৃত্যুর চার ঘণ্টা পর। শুধু একটাই দয়া করেছিল তারা, কৃষ্ণকলির বাবাকে দিয়ে করিয়েছিল আত্মজার মুখাগ্নি। যদিও করিয়েছিল সেটা নিজেদের স্বার্থেই এবং ওপরওয়ালার নির্দেশেই। যেখানে একজন বাবা তার নিজের সন্তানের মুখাগ্নি করে সেখানে তো কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না যে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জিন্দা লাশকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু মানুষের গাফিলতি অথবা কুকীর্তি চাপা দিতে।
শিমুলতলা গাছের নিচে আজ পুরোগ্রাম এসে জড়ো হয়েছে। শিমুলগাঁয়ের পনেরো বছর কন্যার দেহ ভস্মীভূত হওয়ার পর চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি এখনও। ধর্ষিতা, রক্তাক্ত বালিকা যেন চেয়ে আছে এই রাজ্যের মুখপানে। তার নীরব প্রশ্ন ‘বড্ড যন্ত্রণা মা, বড় ব্যথা মা’Ñ পুরো গ্রামমবাসীকে বিব্রত করছে। অপেক্ষা করছে তারা তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পঞ্চায়েতকর্ত্রীর মুখপানে। একজন নারী তিনি, আশা সবার- সুবিচারই পাবে শিমুলগাঁয়ের সবার আদরের, সবার গর্বের কৃষ্ণকলি। সে তো এই গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল করার জন্যই জন্ম নিয়েছিল এখানে।
অবাক হয় গ্রামবাসী, যখন পঞ্চায়েতকর্ত্রী বলেন, আমার কানে এসেছে এই মেয়েটির, কী যেন নাম তারÑ কৃষ্ণকলি, তার নাকি স্বভাব-চরিত্রের ঠিক ছিল না। এই বয়সেই তার অনেক ছেলেবন্ধু। মেয়েবন্ধু তো তার ছিল না বলেই শুনেছি। এই ধরনের মেয়েদের কপালে এ রকম ঘটনা ঘটা কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা সবাই নিজের নিজের বাড়ির মেয়ে-বৌদের সাবধানে থাকতে বলবেন। যার-তার সাথে মিশতে দেবেন না। অনস্বীকার্য, এটা একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বলে কিছু ক্ষতিপূরণের, মেয়েটির পরিবারের জন্য।
পাশে দাঁড়ানো সিকদারবাবু, গুপ্তবাবু, হালদার বাবু সবাই এক সাথে মাথা নাড়তে-নাড়তে সায় দেন পঞ্চায়েতকর্ত্রীর কথাকে।
গ্রামবাসী নির্বাক। গোটা গ্রাম বুক গুমরে কাঁদলেও করুর মুখে কোনো প্রতিবাদ নেই। শাসকের এই দামাল ছেলেরা পাছে তাদের ঘরের মা-বোন-মেয়েদের নিয়ে টানাটানি করেÑ এ আতঙ্কে হয়তো গ্রামবাসী নির্বাক হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে তাদের বুকে যে প্রতিবাদের দামামা বেজে ওঠেনি, সেটা ভাবা হয়তো ভুল হবে। শুধু গ্রামবাসী কেন, শ্মশানে দাঁড়িয়ে সন্তানহারা পিতাও একটা কথাও মুখ থেকে বের করতে পারেনি, বের করলে যে তারও পরিণতি তার নিজের মেয়ের মতনই হবে।
গ্রামবাসীকে চুপ করে থাকতে দেখে, ভিড়ের পিছনে ঠোঁট, নাক, কপালে প্লাস্টার লাগানো বিশু হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে -আমি জানি কৃষ্ণকলির ওপর হামলা হয়েছে। এখানে যা বলা হয়েছে সব ভুল। কৃষ্ণকলি খুব ভালো মেয়ে। প্রত্যেক বছর স্কুলে প্রথম হয়।
পঞ্চায়েতকর্ত্রী একটু বাঁকা চোখে ডানদিকে মাথাটা হেলিয়ে ছেলেটিকে খুঁজতে থাকেন। তার মধ্যেই বিশুর বাবা, বিশুর দুই কাঁধের ওপর দুইহাত দিয়ে দাবিয়ে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। বিশু সেইদিনই ঠিক করে, বের করবে একটি প্রতিবাদের নীরব মিছিল।