ড. আনোয়ারা আলম »
জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, কালজয়ী মূল্যবোধ লালনের শিক্ষা এবং আগাম দিনের সমাজ ও সভ্যতার সৃজন ও ধারণের জন্য শিক্ষা – এই তিনটি পরস্পর বিপরীতধর্মী দর্শনের সমন্বয় সাধনই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য।শিক্ষার মাধ্যমে বিবেক জাগ্রত হয়, মনের মাঝে আলোর দিগন্ত প্রসারিত হয়। যদিও বহুতান্ত্রিক বিশ্বে মুক্তবাজার অর্থনীতির দাপটে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষ্ময়কর আবিষ্কারের ফলে মানব উন্নয়ন হচ্ছে বটে তবে একই সাথে পুরো বিশ্ব আজ দুইভাগে বিভক্ত। তথাকথিত উন্নত দেশের আধিপত্য বিস্তারের যে আগ্রাসী আচরণ তাতে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। একদিকে রাশিয়া ও ইউক্রেন অন্যদিকে উন্নত দেশের মদদে ফিলিস্তিনে যে হত্যাকাণ্ড চলছে তা প্রতিনিয়ত মনের মাঝে একটা হাহাকার তৈরি করেছে।
প্রশ্নটা এসে যায় শিক্ষা তো মানব উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ। তাহলে শুধু শিক্ষিত হলেই বা আয় হলেই বা দীর্ঘায়ূ হলে বা সামগ্রিকভাবে বৈষয়িক উন্নয়ন হলে কি মানব উন্নয়ন হচ্ছে? একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষ যে নিজের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে কিন্তু সমাজের বা মানুষের জন্য কোন অবদান নেই তিনি কি প্রকৃত শিক্ষিত না-কি যিনি মানুষের কল্যাণে, সমাজের উন্নয়নে বা দেশের সংকটে এগিয়ে আসেন তিনি শিক্ষিত বা তাঁর ভেতরে শিক্ষার আলো পড়েছে এটি ভাববো!
এক্ষেত্রে নিরক্ষর মানুষকেও আমরা বলতে পারি তার ভেতরটায় মানবিক গুণাবলি আছে যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এসেছেন কৃষক বা অতি সাধারণ মানুষ। বেদনা ও আক্ষেপ নিয়ে বলতে হয় তথাকথিত কিছু উচ্চ শিক্ষিত মানুষের লোভ বা দুর্নীতি বা মানবিকতাবর্জিত আচরণে নানা প্রশ্ন জাগে। তাঁদের অনেকের মধ্যে দেখি স্বার্থপরতা, অন্যায়ের প্রবৃত্তি বা হিংসা বা দলাদলি। তাহলে কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন গলদ আছে?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন- মানুষের প্রথম পাঁচ বছরে তার মধো কিছু প্রবণতা ও মূল্যবোধ দানা বেঁধে চলে। তাই একদিকে সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষার সাথে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব বেশি দিতে হয়। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা না মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা বা বিকশিত করার জন্য নৈতিক শিক্ষা দরকার। এছাড়া তাকে নিয়ে যেতে হবে প্রকৃতির সান্নিধ্যে একই সাথে তাকে শোনাতে হবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা। জাগাতে হবে দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আমরা উৎপাদনমুখী শিক্ষা ও মানবতা বিকাশের শিক্ষা, দুটোই চাই। এই সমন্বয়ের সাধনার কাজ গবেষকদের- যাঁরা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের। এক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে পরীক্ষামুখী শিক্ষা হচ্ছে একটা বড়ো গলদ।
শিক্ষার লক্ষ্য মানুষে মানুষে বৈষম্যরোধ বা বন্ধন বাড়ানো। কিন্তু তা কি হচ্ছে! বরং শিক্ষার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বৈষয়িক উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় গ্রাম থেকে উঠে আসা উচ্চ শিক্ষিত ছেলেটি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। বরং অনেকে উন্নাসিক হয়ে শেকড় বিচ্ছিন্ন এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক মানুষে পরিণত হচ্ছে। এমনকি অনেকে মা বাবা বা আত্মীয়স্বজন থেকেও আলাদা হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য মানবিক উন্নয়ন বা মানব উন্নয়নের শর্ত হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মাঝে দলাদলি বা আর্থিক কারচুপি বা দলীয়করণের রাজনীতি! যেখানে কখনো কখনো ছাত্রদের ও ব্যবহার করা হচ্ছে যা একধরনের অশনিসংকেত। তাহলে শিক্ষার উদ্দেশ্যই তো একেবারে ধুলোয় মিশে যায়।
মানব উন্নয়ন মানে শান্তি ও মৈত্রীর সমন্বয়। এছাড়া সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন। যদিও আবারও বলতে হয় তথাকথিত উন্নত দেশের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তাহলে শিক্ষা ও মানব উন্নয়নের মাঝে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থান দেখছি এক হতাশা নিয়ে। এরাই তো পুরো বিশ্বে একটা চরম মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রেও বিশ্বের অনেক দেশ একেবারে নিরব। তখনই প্রশ্ন জাগে একুশ শতকের বিস্ময়কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন কি মানুষকে রোবট বানিয়ে ফেলছে! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একেই বলেছেন ‘সভ্যতার সংকট’।
তবে এরপরে ও বলতে হয়— শিক্ষার উদ্দেশ্য মানব উন্নয়ন। যার অপব্যবহার করছি অনেকে।
আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশা হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমে ভালোমানুষ তৈরি করা। এক্ষেত্রে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার জন্য সাজাতে হবে। যদিও স্বাধীনতার এতো বছর পরেও এ নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে শিক্ষিত মানুষ জনসম্পদে পরিণত হচ্ছে কিনা। কোথায় গলদ তা চিহ্নিত করতে হবে। আমাদের গুণগত মান দরকার। সংখ্যা নয়। চেষ্টা চলছে তা অনস্বীকার্য। Non formal Education এর মধ্যে দিয়ে, Distance Education এর মধ্যে দিয়ে, নানাভাবে বেসরকারি উদ্যোগকে আরও বেশি সহায়ক শক্তি হিসেবে পেলে শিক্ষার সমস্যা আরও অনেকখানি দূর করতে পারবো।