রায়হান আহমেদ তপাদার »
শিক্ষা গ্রহণ আনন্দের, আনন্দের মাধ্যমে যে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় তা হয় উদ্দীপনামূলক-তাই বাংলাদেশের সমাজকে এগিয়ে নিতে বই উৎসব নিশ্চয়ই শিক্ষার অগ্রগতির একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।করোনায় থমকে আছে বিশ্ব। কবে মুক্তি মিলবে তা অজানা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ ভাইরাসের প্রভাব দেখা গেছে। অনেক দেশেই করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যখাতসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের অবস্থাই শোচনীয়। উন্নত দেশে করোনার যে ধরনের প্রভাব পড়েছে সেখানে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা আরও কঠিন।বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৬ কোটি বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে পুরো একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী ঘটনা। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে পুরো দেশ লকডাউন থাকায় সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিলেও এর মধ্যে বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
আমরা সবাই জানি,শিক্ষা আমাদের নিজেদের চিনতে সাহায্য করে। শিক্ষার আলো যত ছড়াবে জাতি হিসেবে তত আমরা আলোকিত হব-এ সত্য বোঝার জন্য তেমন একটা জ্ঞান-গরিমার প্রয়োজন নেই। আবার যদি বলি শিক্ষা নামের দাওয়াই দিয়েই ভেতরের পশুশক্তিকে কাবু করা যায়, এ কথাও অনেকেই জানেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় শিক্ষা গ্রহণে যত বাধা। যাহোক শিক্ষার মূল শিক্ষা আমাদের ভেতর ঢুকুক বা না ঢুকুক, শিক্ষা নিতে ও দিতে আমরা কিন্তু বদ্ধপরিকর। শিক্ষার এক যুগান্তকারী দিক হচ্ছে প্রতিবছর বছরের শুরুতে কোমলমতি বিদ্যার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া। নতুন শ্রেণিতে ওঠার জন্য কোনো পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হয়নি। অনেক সময় পরে তবুও কিছু একটা শিক্ষার্থীরা পেল। মন্দের ভালো হয়ে থাকল মাউশি কর্তৃক অ্যাসাইনমেন্ট প্রটোকল। এটাতে শিক্ষার্থীরা তেমন উপকৃত হয়েছে বলে মনে হয় না। এখানে ব্যস্ততা বেড়েছে অভিভাবকদের। তারাই ইন্টারনেটে খোঁজ নেয়। এবং এটাও হয়েছে কোনো কোনো অভিভাবক নেটের দুনিয়া থেকে অ্যাসাইনমেন্টের উত্তরপত্রসহ সন্তানদের জন্য সংগ্রহ করে দিয়েছেন। এতে শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা তো প্রকাশ পেলই না বরং শিক্ষার্থীর ভেতর কোমল শাঁসযুক্ত মনটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। দেখে দেখে লেখা অনেকের কাছে বিরক্ত ও বেদনাদায়ক।
অন্যদিকে অনেকের কাছে অটোপাস শব্দটি অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে এক হতাশার নাম। অটোপাসের বিকল্প কোনো বিষয় ভাবলে হয়তো শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতো বলেই মনে হয়। এখন এই সময়ের শিক্ষার্থীরাও ভাবতে বসেছে আবার হয়তো পরবর্তী বছরে ও পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতেও এ ধরনের পাস হবে। অনেক ছাত্রছাত্রী বাসাতে পড়তেও বসছে না। এ ধরনের চিন্তা-চেতনা পরবর্তী বছরগুলোর শিক্ষার্থীদেরও এক আশঙ্কায় ভরিয়ে দিয়েছে। নতুন বছর মানে নতুন বইয়ের গন্ধ। শিক্ষা কার্যক্রমে স্থবিরতা থাকলেও বই ছাপানোর কাজে ঘটেনি কোনো ব্যত্যয়। এ বছরে ৩৫ কোটি বই ছাপা হয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকে ২৪ দশমিক ৪১ কোটি, আর ১০ দশমিক ৫৪ কোটি বই প্রাইমারি পর্যায়ের। বইসংক্রান্ত এত বিশাল কর্মযজ্ঞ এক বিশাল কাজ বলেই মনে হয়। বই উৎসবের ইতিহাস খুব পুরনো নয়। ২০১০ সাল থেকে বই উৎসবের ধারণাটা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জাগরিত করে। করে আন্দোলিত। এই দিনটিতে দেশে এক ইমেজ ও আমেজ তৈরি হয়। সাধারণের মাঝে দিনটি বেশ তাৎপর্যময়। একটা সময় ছিল শিক্ষার্থীদের হাতে সঠিক সময়ে বই পৌঁছে দেওয়া সমস্যার পাহাড় হয়ে দাঁড়াত। আবার এটাও ছিল, বোর্ডবইয়ের সঙ্গে নোটবইও কিনতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের বাধ্য করা হতো। সে সময়ের হয়েছে অবসান। এখন শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে বই, পাচ্ছে উপবৃত্তি। এতে করে অনেক গরিব পরিবারের সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া সহজতর হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে সরকারের উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসনীয়।২০১০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত মোট ৩৩১ দশমিক ৩৮ কোটি বই বিতরণ করা হয়েছে। এটা এ দেশের জন্য চাট্টেখানি কথা নয়। ২০২১ সালের প্রথম দিনেই বই উৎসব হবে না। তবে বিশেষ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছবে। পড়াশোনাকে সচল রাখতে বছরের প্রথম দিনে বই- এটা বেশ ভালো। তবে তা শিক্ষার্থীদের কী তেমন কোনো কাজে লাগবে! বর্তমান করোনা মহামারী যদি আরও কয়েক বছর থাকে তবে কী আমরা শুধু বছর বছর নতুন নতুন বই প্রদান করেই আমাদের প্রিয় শিক্ষাবান্ধব সরকার দায় সারবে। দুর্যোগ আসতে পারে। বিকল্প উপায়ও আমাদেরই ভাবতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের মাঝে আলোর রোশনাই ছড়াতে হবে। প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সিফটে ভাগ করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সপ্তাহে দু-চার দিন শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষণ কার্যক্রম চালালে ভালো হতো। কবে কোনদিন করোনা এ দেশ থেকে যাবে বা নির্মূল হবে তা তো কেউ জানে না। আবার ভ্যাকসিন এলেও তা সকলকে দিতে অনেক সময় লাগবে। এ পরিস্থিতি থেকে আমাদের উত্তরণের পথ খোঁজা এখন সময়ের দাবি।
অপরদিকে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে ১৭টি অভীষ্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে (এসডিজি) প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে।
এই ১৭টি অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে ১৬৯টি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও ২৩২টি পরিমাপক রয়েছে। যার মধ্যে ৪ নম্বর অভীষ্ট হলো মানসম্মত শিক্ষা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়নে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক তা বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। যেমন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদরাসাভিত্তিক ইবতেদায়ি ও কওমি শিক্ষাব্যবস্থা এবং এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা, বেসরকারি ও প্রি-ক্যাডেট প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। প্রণিধানযোগ্য যে, টেকসই উন্নয়নের জন্য গুণগত শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যার শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভসূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একযোগে জাতীয়করণ করেন। এ ছাড়া কয়েক শ ইবতেদায়ি মাদরাসাকে এমপিওর আওতায় আনয়ন করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরো পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে তিন দফার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি।
গত বছরের শেষ দিকে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে। এ বছরে এসে তা মহামারি আকার ধারণ করেছে। যেখানে প্রকোপ সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, ক্লাস চলে অনলাইনে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তক উৎসব তখনই অর্থবহ হবে যখন মানসম্মত শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে। শিক্ষা হতে হবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। শিক্ষার মান নিশ্চিত করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সে চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গেই মোকাবেলা করতে হবে। নতুন বছরে বই উৎসবে আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত, শুধু নতুন বই বিতরণ নয়, প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা, যাতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে। আরো প্রয়োজন একক শিক্ষানীতি, যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেবে, বিভিন্ন শিক্ষানীতি চালু করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি না করে একক শিক্ষানীতি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট