শিক্ষার উদ্দেশ্য

ড. আনোয়ারা আলম »

সভ্যতার সৃজন যেমন জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে শুরু তেমনি জ্ঞান চর্চাই এখনও সভ্যতার সূতিকাগার। জ্ঞানচর্চাই সুবিন্যস্ত রূপাবেশে আধুনিককালে শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষা হচ্ছে জাতীয় জীবনে এক ধরনের বিনিয়োগ। জাতীয় জীবনের সার্বিক অগ্রগতি সাধনে শিক্ষা বিভিন্নভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার জাতীয় উন্নতির পরোক্ষ প্রভাবে শিক্ষা পদ্ধতিরও সমৃদ্ধি ঘটে। নিরন্তর উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগিয়ে যাওয়াকেই আমরা শিক্ষার অগ্রগতি বলে ধরে নিতে পারি।
স্বাধীনতা অর্জনের পরে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. কুদরত ই খুদার নেতৃত্বে কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা-ের পর এটি হারিয়ে যায়। এরপরে জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে কতো পরীক্ষা নিরীক্ষা, কাটাছেঁড়া। একুশ শতকেও এখনো চলছে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা। শিক্ষার্থীরা হয়েছে গিনিপিগ।
ইংরেজরা নিশ্চয়ই এমন কোন শিক্ষানীতি প্রবর্তন করতে চাননি যাতে তাদের কর্তৃত্ব বিঘিœত হতে পারে। তখন এক ধরনের দাসত্ব মনোবৃত্তি গড়ে তোলাই সে শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তাদের বিতাড়নের পরেও শিক্ষানীতির মৌল প্রাণধর্ম থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবে লোকজন সচেতন হয়েছে। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের লোকজনও তাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য চেষ্টা করছে।
তবে আমার কথা হলো শিক্ষার উদ্দেশ্য কি। আত্মার সাধনা ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সততা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে। কিন্তু বাস্তবে কি দেখছি। শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন কেবলই বৈষয়িক উন্নয়ন। হ্যাঁ এটি হতেই পারে।
শিক্ষার উদ্দেশ্য এখন অনেকাংশেই শুধু মাত্র নিজের উন্নয়ন। সেটাতেও সমস্যা নেই। প্রশ্নটা আসে দুর্নীতি প্রশ্নে। আমাদের উন্নয়নের সব অর্জন যাচ্ছে কাদের পকেটে! কারা দুর্নীতি করে দেশের সুনামকে ব্যহত করছে? এমন কি মহামারিও এই দুর্নীতিবাজদের ঠেকাতে পারেনি। এখন বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়েও তাদের হাতে বন্দি সাধারণ মানুষ। সবকিছুতেই সিন্ডিকেট। সবার কন্ঠে তখন একটাই সুর। প্রত্যেকটা অফিস যেন দুর্নীতির আখড়া। সরকারি অফিসগুলোতে গেলে বোঝা যায় তথাকথিত কিছু শিক্ষিত মানুষ কতোটা দুর্নীতিপরায়ণ। সংবিধানে লেখা প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। আসলে গোলাম। মার্কসের মতে ‘মানুষ অর্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়’ বাস্তবতা তাই বলে। শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন। তাই দেখি শিশুকাল থেকে আমরা তাদের কিভাবে প্রতিযোগিতায় ফেলে দিচ্ছি। কেবলই দৌড়ে। কেন! গোল্ডেন প্লাস, এ প্লাস অতএব সংবর্ধনা, অতএব তাদের নিয়ে সংবর্ধনা। এই প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে শৈশব থেকে তাদের মনমানসিকতার শুভ মূল্যবোধগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। তারা হয়ে ওঠে রোবট।
এরই অবকাশে একটা সময়ে তারা হয়ে উঠে শিক্ষিত কিন্তু স্বশিক্ষিত খুব কম।
শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি শুধু বৈষয়িক বা আর্থিক উন্নয়ন হয়,তাহলে দেশের জন্য অশনিসংকেত। আমরা ভালো শিক্ষক বা ভালো বুদ্ধিজীবী বা ভালো রাজনৈতিক নেতা পাবো না। বস্তত পক্ষে তাই হচ্ছে। একেকজন উচ্চশিক্ষিত লোকের দুর্নীতির চেহারা যখন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তখন আমরা হতভম্ব হয়ে যাই।
অর্থপাচার, বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে দুর্নীতিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রে যখন দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে তখন দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। আর একই সাথে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। তথাকথিত কিছু হাইব্রিড নেতাদের দৌরাত্ম্যে প্রশ্ন জাগে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব কার হাতে! কোথায় যাচ্ছি আমরা।
শিক্ষার সাথে সাহিত্য ও সংস্কৃতি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। গভীর হতাশায় বলতে হয় ওখানেও ঢুকে পড়েছে দুর্নীতি। সাপের ছোবলের মতো বিষাক্ত হচ্ছে এই অঙ্গনও।
সমাধানের জন্য কি করণীয় তা ভাবতে গেলে চরম অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে ভাবনার জগৎকে। কারণ যারা দেশের এই সমস্যার সমাধানে নেতৃত্ব দিতেন অতীতে, তাঁরাও নিশ্চুপ। কারণ এখানেও চলছে লেজুড়বৃত্তি তথা পদক পদবির লোভ বা মোহ।
পরিশেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা দিয়ে শেষ করতে হয়- ‘১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন -দুর্নীতি কারা করে, আমার কৃষক না, আমার শ্রমিক না-তাহলে ঘুষ খায় কারা, বিদেশি এজেন্ট হয় কারা-এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত’।