‘শিক্ষার্থীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ’-ড. লায়লা খালেদা

নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন নিপীড়ন আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের পথে একটি বড় বাধা। এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা শুধু যে সমাজের নিম্নস্তরে ও অনিরাপদ স্থানগুলোতেই হচ্ছে এমন না, আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন প্রকৌশল ও জীব প্রযুক্তি বিভাগের সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌননিপীড়ন বিরোধী সেলের সাবেক সদস্য ড. লায়লা খালেদা।
সাক্ষাতকার নিয়েছেন সুপ্রভাতের প্রতিবেদক অনিন্দিতা সরকার প্রথা।

সুপ্রভাত : ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. লায়লা : সহিংসতা যে শুধু শারীরিক তা নয়। মানসিক ও সামাজিক নির্যাতনও এর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় সাধারণত মানসিক চাপ, অপমান, বঞ্চনাকেও সহিংসতা হিসেবে ধরা হয় না, অথচ এগুলো নারীর মনে ও জীবনে গভীর ক্ষত তৈরি করে।

সুপ্রভাত : শিক্ষিত সমাজেও কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন?
ড. লায়লা : শিক্ষার পরিমাণ বেড়েছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার অনেক সময় অভাব দেখা দিচ্ছে। পরিবারের ভেতর থেকে ছেলেমেয়েদের প্রতি সমান আচরণ নিশ্চিত না করলে শিক্ষিত হলেও মানসিকতায় পরিবর্তন আসে না। তাছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে সবকিছু এখন হাতের মুঠোয় হওয়াতে বিভিন্ন ধরনের বিকৃত কনটেন্ট আমাদের সমাজের উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে অতি সহজেই পৌঁছে যাচ্ছে। এই বিষয়টিও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে আমি মনে করি।

সুপ্রভাত : এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল কীভাবে কাজ করে?
ড. লায়লা : আমাদের সেলে যে কেউ সরাসরি লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। সেলের দুটি কক্ষ রয়েছে। নিম্নকক্ষ অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত করে এবং উচ্চকক্ষতে তাদের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য সুপারিশসহ জমা দেয়। এরপর উচ্চকক্ষ পুনরায় তদন্ত ও বিবেচনা সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিনারি কমিটিকে অবগত করে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিচয় গোপন রাখা হয় এবং তাকে নিরপেক্ষভাবে কিন্তু সহানুভূতির সাথে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়

সুপ্রভাত : অভিযোগ করতে শিক্ষার্থীরা কতটা সাহসী হয়ে এগিয়ে আসতে পারে বলে মনে করেন?
ড. লায়লা : শুরুতে অনেকে দ্বিধা করলেও এখন শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছে। তবে এখনও ভয়, সামাজিক চাপ ও ভবিষ্যৎ নিযে উদ্বেগ ইত্যাদি কারণে অনেককেই পিছিয়ে যেতে দেখা যায়। তবে আমরা চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের সাথে এমন আচরণ করার যেন তারা কোন সমস্যায় পড়লে আমাদের সাথে নির্দ্বিধায় যোগাযোগ করতে পারে।

সুপ্রভাত : এই সেলকে আরও কার্যকর করার জন্য কী কী পরিবর্তন জরুরি?
ড. লায়লা : আমি ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সেলের সদস্য ছিলাম। কাজ করতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, সেলের নীতিমালা ও কাজের ধরন খুবই ভালো। কিন্তু, আমাদের কার্যপ্রক্রিয়া একটু ধীর গতি সম্পন্ন। আমাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব, সরকারি ছুটি, ইত্যাদির কারণে তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে সম্পন্ন করাটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু পরিবর্তন আনাটা জরুরি। বিচার যত দেরিতে হয়, সুবিচার পাওয়াটা তত কঠিন হয়ে পড়ে।

সুপ্রভাত : সবচেয়ে বেশি কোন ধরনের অভিযোগ পেয়েছেন?
ড. লায়লা : বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রী দুজনে একজন আরেকজনের সম্মতিতেই একটি সম্পর্ক স্থাপন করে ও ঘনিষ্ঠ হয়। পরে হয়তো দেখা যাচ্ছে যে, ছেলেটা সে সম্পর্কটা রাখতে চাইছে না অথবা তার অন্য কাউকে পছন্দ হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনায় ধর্ষণের অভিযোগ বেশ কিছু পেয়েছি। এছাড়াও দুই একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগও পেয়েছিলাম।

সুপ্রভাত : শিক্ষকেরা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কি ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারেন?
ড. লায়লা : এক্ষেত্রে আমি মনে করি, শিক্ষকরা নারী-পুরুষ উভয় ধরনের শিক্ষার্থীর সাথে একটি ভালো সম্পর্ক তৈরি করলে এ ধরনের ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে শিক্ষকদের নারী ও পুরুষ উভয় শিক্ষার্থীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলাটা গুরুত্বপূর্ণ। নারী শিক্ষার্থী যদি কোনভাবে অনিরাপদ বোধ করে, তাহলে সে সহজেই যেন তার শিক্ষককে অবগত করতে পারে সেই পরিবেশ আমাদের নিশ্চিত করা উচিত। একজন পুরুষ শিক্ষার্থী যদি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, এলোমেলো চিন্তা ভাবনা করে, তার অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে। শিক্ষকরা মানসিক সহায়তা এবং পথপ্রদর্শনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসতে পারেন।

সুপ্রভাত : আমাদের প্রজন্মের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
ড. লায়লা : নারী-পুরুষ সমান মর্যাদার মানুষ। সহিংসতা বা বৈষম্য কোনো সভ্য সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। নারী ও পুরুষের অবশ্যই একজন আরেকজনের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ করতে হবে। তবে আত্মসচেতনতাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি যাতে না হতে হয় সে বিষযে সাবধান থাকাটা উচিৎ।