শিক্ষকতার মর্যাদা ও বর্তমান সংকট: এক গভীর অবলোকন

সনেট দেব »

আদিকাল থেকেই মানব সমাজে শিক্ষক বা গুরু শুধুমাত্র বিজ্ঞানের পাঠ্যদাতা নয়; তিনি ছিলেন আলোর চালক, মানসিক আদর্শের নির্মাতা। সেই আলোকে আমরা সর্বপ্রথম মানবজীবনের গোপন স্তরগুলোর সঙ্গে পরিচিত হই — শিক্ষা, নৈতিকতা, জীবনের উদ্দেশ্য। ভাবি তো, এক সন্তানের জীবনের প্রথম ইতিহাস বলার সময়, তার হাতে প্রথমে কার দৃষ্টান্ত ধরা হয়েছে? বাবা-মা, ঠিক আছে। কিন্তু জীবনের সেই নরম বসুন্ধরায় শিশুটি প্রথম যে মানুষের কথা মনে রাখে, তার গুণবোধ, দায়িত্ব, ধৈর্য — তা অনেক সময়ই সে শিক্ষক বা গুরুর মুখে দেখেছে।
প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল একবার বলেছিলেন, Those who educate children well are more to be honored than parents, for these give only life, those the art of living well. তার মতে, যারা একজন শিশুকে কেবল বেঁচে থাকার কৌশল নয়, বরং মানুষ হয়ে ওঠার পথ দেখায় — তারা পিতামাতার থেকেও অধিক সম্মানপ্রাপ্য। আর এই ধারণা ছিল পুরাতন সভ্যতাগুলোর মেরুদণ্ড: শিক্ষককে শ্রদ্ধা করা, তাঁর আদর্শকে শ্রোতা করা, তাঁর দীক্ষাকে মেনে চলা।
এশিয়ার প্রাচীন শিক্ষাগত ঐতিহ্য যেমন গুরুকুল ব্যবস্থায়, গুরু শুধুমাত্র জ্ঞানী ছিল না; তিনি পিতার মতো দায়িত্বশীল প্রতিপালক, রবিবার নয়, প্রতিদিনের জীবনের পথপ্রদর্শক। সামাজিক মর্যাদা এমন ছিল যে, শিক্ষককে প্রায় দেবদূতের মতো দেখা হতো — তার “আশ্রম” বা গুরুকুল ছিল জ্ঞান ও ন্যায়চিন্তার কেন্দ্র। কিন্তু আজ, সেই গৌরবময় ইতিহাস যত কাছে মনে রাখার চেষ্টা করি, বাস্তব যেন ক্রমেই তার পার্থক্য হারাচ্ছে। শিক্ষকরা প্রতিদিন ন্যূনতম আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্বীকৃতি ও কর্মগত মর্যাদার অভাবের সঙ্গে লড়াই করছেন। ইতিহাসের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠা সেই মানুষরা আজকের যুগে প্রাচীরের পাশে দাঁড়িয়ে চুপিসারে দাঁড়াবার মতো পরিস্থিতি তৈরি করছে—এটি শুধু ব্যক্তিগত দুঃখ নয়, সামাজিক ইম্প্বাস এবং ভবিষ্যৎ নির্মাণে এক গভীর সংকেত।
বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত শিক্ষাকাঠামোর অংশ—এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা—যে বেতন পান, তা দিয়ে একটি পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব। একজন এমপিও সহকারী শিক্ষকের প্রারম্ভিক মূল বেতন মাত্র ১২,৫০০ টাকা। এর সঙ্গে যোগ হয় বাড়ি ভাড়া হিসেবে ১,০০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা—যা বর্তমান বাজারমূল্য, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং পারিবারিক প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। উৎসব ভাতাও মূল বেতনের মাত্র ২৫ শতাংশ, যা বড় উৎসব মৌসুমে শিক্ষকদের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে তুলনীয় নয়। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা তাদের সব ভাতা মিলিয়েও গড় বেতন পান প্রায় ১৪,৫০০ টাকা—যা আন্তর্জাতিক মানে প্রায় ১১৯ মার্কিন ডলার। এ সংখ্যাগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়; এর পেছনে রয়েছে বহু পরিবারের নিঃশব্দ সংগ্রাম, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ, এবং সামাজিক মর্যাদার ক্রমধারায় পতনের বেদনা। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো তুলনামূলকভাবে কিছুটা ভালো হলেও তাদের বাস্তব জীবনও নানা সীমাবদ্ধতায় আটকে থাকে। বাড়তি দায়িত্ব, প্রশাসনিক চাপ, স্কুলভিত্তিক সুবিধাহীনতা এবং সামাজিক প্রত্যাশার বোঝায় অনেক সময় তাদের মানসিক চাপও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক অগ্রগতির পথ সংকীর্ণ হওয়া এবং নানা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা মিলিয়ে দেশে শিক্ষকতার পেশা ক্রমেই কম আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় বেতন কমিশন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে—যা নিঃসন্দেহে একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে যে, প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন হলে শিক্ষকদের আর্থিক স্বস্তি অন্তত কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু শিক্ষক সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে এখনও সন্দেহ রয়ে গেছে—মুদ্রাস্ফীতি, জীবনযাত্রার ব্যয়, খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষার খরচ বাড়ার ফলে এই প্রস্তাব বাস্তবিক অর্থে কতটা আর্থিক সুরক্ষা দিতে পারবে। এমপিও শিক্ষক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে—সর্বনিম্ন বেতন ৩০,০০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১,৫৬,০০০ টাকা হওয়া উচিত। তাদের যুক্তি—একজন শিক্ষক যদি নিজের জীবন, পরিবার, সন্তানদের ভবিষ্যৎ এবং মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হন, তাহলে তিনি পরবর্তী প্রজন্মকে কীভাবে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাবেন?
বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে আরও একটি কারণে—প্রতিবেশী ও বৈশ্বিক চিত্র। ভারতের শিক্ষক প্রারম্ভিক বেতন প্রায় ২৮৫ ডলার, নেপালে প্রায় ৩৩০ ডলার, আর ভুটান ও পাকিস্তানেও বাংলাদেশের তুলনায় তাদের আর্থিক অবস্থান অনেক বেশি স্থিতিশীল। সেখানে শিক্ষকরা শুধু মাসিক বেতনেই নয়, বিভিন্ন ভাতা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং পেনশন সুবিধার মাধ্যমেও স্বচ্ছলতা অনুভব করেন। এশিয়ার উন্নয়মান দেশগুলো—চীন ও ইন্দোনেশিয়া—শিক্ষকদের আবাসন সুবিধা, সার্টিফিকেশন বোনাস, গবেষণা ফান্ড ও প্রশিক্ষণ প্রণোদনা দেয়। ফলে শিক্ষকতা সেখানে একটি সম্মানজনক, নিরাপদ এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়। আরও বিস্তৃত পরিসরে, ওইসিডিভুক্ত উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকরা শুধু আর্থিক নিরাপত্তাই ভোগ করেন না; বরং পেশাগত স্বাধীনতা, গবেষণা স্বাধীনতা, শিক্ষার্থীদের আচরণগত সহায়তা, উন্নত পেনশন সুবিধা এবং সামাজিক মূল্যায়ন উপভোগ করেন। সেখানে শিক্ষককে জাতির মানবসম্পদ বিনিয়োগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে দেখা হয়—অর্থাৎ শিক্ষকতা পেশাটিকে শুধু একটি চাকরি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্ভাবনার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশে শিক্ষকতার এই আর্থিক ও সামাজিক সংকট শুধু শিক্ষক সমাজের সমস্যা নয়; এটি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ—শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। নতুন প্রজন্মের তরুণরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে দেখে যে শিক্ষক হয়ে তাদের ভবিষ্যৎ আর্থিকভাবে অনিশ্চিত, তখন তারা এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলাফলে শিক্ষকতার পেশা ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে কম-মর্যাদাপূর্ণ একটি চাকরি—যেখানে থাকে ত্যাগ, পরিশ্রম, দায়িত্ব, কিন্তু বিনিময়ে থাকে না নিরাপদ জীবন, স্থায়ী আর্থিক সুরক্ষা বা যথার্থ সম্মান। এই অসমতা—বেতন, মর্যাদা, নিরাপত্তা ও পেশাগত মূল্যায়নে—শুধু একটি ফারাক নয়; এটি সমাজের ভবিষ্যৎ জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা। শিক্ষক যখন অসম্মানিত হন, তখন সমাজ তার আদর্শ হারায়; শিক্ষক যখন অরক্ষিত হন, তখন জাতি তার ভবিষ্যৎ হারায়।
বাংলাদেশে শিক্ষকতার প্রতি মেধাবী তরুণদের আগ্রহ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে এক জটিল ও বহুমাত্রিক বাস্তবতা। প্রথমত, শিক্ষকতার আর্থিক প্রতিদান দীর্ঘদিন ধরেই দেশের শ্রমবাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়—কম বেতন, সীমিত ভাতা ও অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা তরুণদের স্বাভাবিকভাবেই অন্য পেশার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে আর্থিক স্বচ্ছলতা, দ্রুত উন্নতির পথ এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা আরও সুস্পষ্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাগত মর্যাদার অবনতি: শিক্ষক আজও শ্রদ্ধেয়, কিন্তু সেই মর্যাদার ধারণা বাস্তব সুবিধা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বা প্রশাসনিক ভূমিকার উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। ফলে শিক্ষকের ভূমিকা অনেক সময় কেবল পাঠদানে সীমাবদ্ধ থাকে, আর রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে সমাজে শিক্ষককে এখন বহুলাংশে “ক্লাস নেওয়া মানুষ” হিসেবে দেখা হয়; জ্ঞানচর্চা, মূল্যবোধ নির্মাণ বা জাতি গড়ার দায়িত্বের মতো বৃহৎ পরিচয়টি ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোয় শিক্ষকতার সঙ্গে অন্যান্য পেশার ব্যবধান এতটাই বেড়েছে যে অনেক তরুণ এই পেশাকে “সুযোগহীনতার বিকল্প” হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। ব্যাংক, কর্পোরেট বা সরকারি প্রশাসনে শুরুতেই যে বেতন একজন কর্মী পায়—তা প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বেশি; পাশাপাশি থাকে পদোন্নতির নিশ্চিত পথ, সামাজিক প্রভাব, পেনশন সুবিধা এবং পেশাগত নিরাপত্তা। এই বৈষম্যমূলক বাস্তবতা তরুণদের মানসিক মানচিত্রে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে শিক্ষকতা বেছে নিলে তাদের উদ্যম, মেধা বা শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন নাও হতে পারে। ফলে শিক্ষকতার প্রতি অনাগ্রহ কেবল ব্যক্তি-চাকরির পছন্দের বিষয় নয়; এটি একটি গভীর সংকেত—আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তার ভবিষ্যৎ ধারণক্ষমতা হারাচ্ছে, এবং সমাজের কাঠামোতে শিক্ষকতার স্থান ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
শিক্ষকতা পেশায় যে মর্যাদা ও সম্মান হাজার বছরের জ্ঞানসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল, তা আজ নানা সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণের চাপে ক্ষয়প্রাপ্ত। এ অবস্থায় প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো রাষ্ট্রীয় নীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্থায়ী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জাতীয় বেতন কমিশনের আধুনিক প্রস্তাব বাস্তবায়ন, শিক্ষকদের মৌলিক বেতন-ভাতা—বিশেষত বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও উৎসবভাতা—বাস্তবসম্মত হারে বৃদ্ধি করা জরুরি। একজন শিক্ষক যেন কেবল টিকে না থাকেন, বরং মর্যাদাসম্পন্ন, নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করতে পারেন—এটি রাষ্ট্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন লক্ষ্য পূরণের মৌলিক উপাদান। পাশাপাশি শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাঁরা শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত উন্নয়নের সক্রিয় অংশীদার হতে পারেন।
শিক্ষকতার প্রতি সামাজিক সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গণমাধ্যম ও জনআলোচনায় শিক্ষকের ভূমিকাকে জীবনের নির্মাতা ও চরিত্রসম্ভারের কারিগর হিসেবে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে পরিবারুস্কুলুসমাজ মিলে শিক্ষার্থীদের মানবিকতা, শ্রদ্ধাবোধ ও কৃতজ্ঞতা শিক্ষায় পুনরায় গুরুত্ব দিতে হবে। এভাবেই “শিক্ষককে সম্মান” একটি সামাজিক চর্চায় রূপ নেবে—শুধু আচরণগত সৌজন্য নয়, মূল্যবোধের অংশ হিসেবে। সমাজের সাংস্কৃতিক পরিসরেও শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা তুলে ধরার উদ্যোগ—সাহিত্য, কবিতা, নাটক, উৎসব বা বিশেষ দিবস—এই মর্যাদাবোধকে আরও গভীর করতে পারে।
শিক্ষা ব্যবস্থার অর্থনীতিকেও পুনর্বিবেচনা করা জরুরি। বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে শিক্ষক বেতন, প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও পেশাগত উন্নয়নে নতুন পথ খুলতে হবে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিয়মিত মূল্যায়ন ব্যবস্থা গড়ে তুললে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগের কার্যকারিতা আরও স্পষ্ট হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে আর্থিক নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ও ক্যারিয়ার গ্রোথ—এই তিনটিকেই সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ উন্নত মানবসম্পদের স্বপ্ন পূরণ করতে হলে প্রথম শর্ত হচ্ছে—যোগ্য, মর্যাদাসম্পন্ন ও অনুপ্রাণিত শিক্ষক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট