অরূপ পালিত »
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের কবিদের অন্যতম কবি শঙ্খ ঘোষ। পঞ্চাশের কবি হলেও মানসিকতা ও জীবনদর্শনে তিনি তাঁর সময়ের অন্যান্য কবিদের থেকে আলাদা। তাঁর কবিতার ভাব ও ভাষা যেমন পৃথক, তেমনি কবিতায় অনায়াস প্রতিবাদও কম্পমান। ছন্দের মোহময় কারুকার্যে কবিতাকে তিনি তুলে এনেছেন অত্যন্ত সুচারু এবং শৈল্পিকতায়। কবির বিখ্যাত ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কবিতাংশ :
একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোমার জন্যে গলির কোণে
ভাবি আমার মুখ দেখাব
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।
একটা দুটো সহজকথা
বলব ভাবি চোখের আড়ে
জৌলুসে তা ঝলসে ওঠে
বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে। (মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)
লিখতে বসে তিনি জীবনকে দেখেছেন। প্রকৃতিতে বুঝেছেন। তাঁর কবিতায় রয়েছে মুগ্ধতার বিস্ময়কর রূপ। তাঁর প্রতিটি কবিতায় মানুষ, প্রেম, প্রকৃতি আর মানুষের স্বার্থপরতার নৃশংস মিশ্রণ রয়েছে ।
সংহত আবেগের আত্মমগ্ন কবিতা রচনা করলেও শঙ্খ ঘোষকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী কবি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কবির প্রতিবাদ কখনো সমাজ সংস্কারে মৃদু, কখনো ক্ষমতাতন্ত্রের বিরুদ্ধে উচ্চকিত। তিনি সময়ের দগদগে ক্ষত চিহ্নিত করেই কবিতা রচনায় ব্রতী হয়েছেন।
বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদারের ভাষ্যমতে, ’১৯৪৭ সাল যেন বিভীষিকা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া স্বাধীনতাকে কমিউনিস্ট পার্টি অলীক আর মিথ্যা বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা সত্ত্বেও এই স্বাধীনতা যে এক উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হয়েছিল সবকিছু এক নতুন আনন্দের দিকে চলেছে। শিশুরাষ্ট্রের শাসকদের কার্যকলাপে স্বাধীনতার মোহ অবশ্য অচিরেই ফিকে হতে শুরু করেছিল। কোচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলের ওপর গুলি করেছিল পুলিশ। কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষকে লিখতে হয়েছিল : ‘যমুনাবতী’ কবিতাটি।
নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে
একটু আগুন দে।
হাতের শিরায় শিখার মতন
মরার আনন্দে। (যমুনাবতী)
১৯৫২ সালে সদ্যতরুণ এই কবির লেখা একটা কবিতা নাড়িয়ে দিয়েছিল আপামর কাব্যপ্রেমীকে। এক কিশোরীর মৃত্যু, ভাতের জন্য মৃত্যু, ভাতের বদলে বুলেট। কবি কিশোরীর চিতার দহনে দাউ দাউ করে জ¦লে উঠলেন নিজেও। প্রতিবাদী কবি বিদ্রোহী কবি হিসাবে অন্যায়-অবিচারে সর্বক্ষণ ছিলেন সোচ্চার। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না কিন্তু নিচুতলার মানুষ, দরিদ্রদের জন্য সব সময় কলম চালিয়ে গেছেন। তিনি শিশু এবং কৃষকদের জন্য কবিতা লিখে গেছেন। তাঁর বিদ্যাসাগর, সকালবেলার আলো, শব্দ নিয়ে খেলা, সেরা ছড়া, ছোট একটা স্কুল, মহর পথের ধুলো, ছড়াসংগ্রহ এবং ইচ্ছাপ্রদীপ আজকে আমার পরীক্ষা নেই উল্লেখযোগ্য। তাঁর ছোটদের কবিতা পাঠ্যবইয়েও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শঙ্খ ঘোষ নামটি কবির আসল নাম নয়। তাঁর নামটি হল চিত্তপ্রিয় ঘোষ। শঙ্খ নামটি ছিল তাঁর ডাকনাম। সাহিত্যিক এবং কবি জীবনে এই নামেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। কবি শঙ্খ ঘোষের জন্ম ১৯৩২ সালের ফেব্ররুয়ারি মাসের ৫ তারিখে অধুনা বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববঙ্গের চাঁদপুর জেলায়। তবে বংশানুক্রমে তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারীপাড়া গ্রামে। এসব তথ্য পরবর্তীকালে কবির নিজের মুখ থেকেই জানতে পারা যায়। তাঁর পিতা নাম মনীন্দ্র কুমার ঘোষ। তিনিও পেশায় ছিলেন একজন অধ্যাপক। তাছাড়া সেই সময় বাংলা ভাষার একজন স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। মনীন্দ্র কুমার ঘোষ রচিত ‘বাংলা বানান’ গ্রন্থটি সেই সময় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। কবির মাতার নাম ছিল অমলা বালা দেবী। পিতা চাকরিসূত্রে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনাতে কর্মরত থাকায় প্রাথমিক পর্যায়গুলি কবি সেখানেই কাটান।
শঙ্খ ঘোষের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হল তাঁর কাব্য ও সাহিত্যচর্চা। বাঙালি তাঁকে মূলত কবি হিসেবে চিনলেও, তিনি বিপুল সংখ্যক গদ্যও রচনা করেছিলেন। এছাড়া রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। অন্যদিকে শঙ্খ ঘোষের কাব্যরচনায় আলাদা করে কোন ভূমিকার প্রয়োজন হয় না। বাংলা কবিতার জগতে তাঁর অবদান অপরিসীম। তার রচিত ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ, ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলো বাঙলা কবিতাপ্রেমীদের মনের অন্দরমহলে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। কিছু কিছু কবিতায় পাই এক পরিপূর্ণ জীবনের নির্যাস।
শঙ্খ ঘোষ তাঁর কবিপ্রতিভার দ্বিমুখী চরিত্রে কবি জগতে লাভ করেছেন এক অদ্ভুত অনন্যতা। একদিকে তাঁর কলমে দৃপ্ত শব্দে ওঠে এসেছে কঠোর সামাজিক তথা রাজনৈতিক বাস্তবতা, সমাজের নিচুতলার মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা। অন্যদিকে কোন কোন কবিতায় এই মানুষইি ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছেন মনের অবচেতনে। তাছাড়া অতি সরল কথ্যভাষায় অসামান্য কবিতাগুলির সংযোজন তাকে পাঠকদের হৃদয়ের নিকটবর্তী করে তুলেছে।
কবি ও সাহিত্যিকের পাশাপাশি একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেও তাঁর প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল। শঙ্খ ঘোষের লিখিত ‘উর্বশীর হাসি’, ‘শব্দ আর সত্য’ ইত্যাদি প্রবন্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে বিশিষ্ট রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর রচিত ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থ।
শঙ্খ ঘোষ রাজনৈতিক মতাদর্শগত দিক থেকে কোনোদিনই সুবিধাবাদী দলভুক্ত ছিলেন না। তাঁর মতাদর্শে কখনোই আদর্শগত কঠোরতা কিংবা তাত্ত্বিকতার আড়ম্বর চোখে পড়েনি। যখন যে বিষয়টিকে তিনি ঠিক বলে মনে করেছেন, তাকেই তিনি সমর্থন করেছেন মুক্তকণ্ঠে। তাঁর সাহিত্যসাধনা থেকে শুরু করে সমগ্র জীবনযাপনের মধ্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সচেতন রাজনৈতিক সত্তা। এ প্রসঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক কবিতা কিংবা প্রবন্ধগুলো বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।
প্রসঙ্গত শঙ্খ ঘোষের রচিত ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ (১৯৯৩) রাজনৈতিক কাব্যগ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই কাব্যগ্রন্থটিকে কবি অলংকৃত করেছিলেন বিস্ফোরক সব রাজনৈতিক কবিতা দ্বারা। অন্যদিকে জীবনের অন্তিমপর্বে পৌঁছেও সমকালীন রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। ২০১৯ সালে তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন।
চিত্তপ্রিয় তথা শঙ্খ ঘোষের সমগ্র জীবনটাই অসামান্য সব কর্মদ্বারা অলংকৃত। তাঁর এই সকল অপূর্ব সৃষ্টিগুলোর জন্য তিনি সমগ্র জীবনে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি লাভ করেন বিখ্যাত সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে ‘রক্তকল্যাণ’ শীর্ষক একটি অনুবাদের জন্য আবার তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার দ্বারা ভূষিত করা হয়। ওই একই বছরে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত করে। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাঁকে ভারতবর্ষের তৃতীয় সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। আবার ২০১৬ সাল নাগাদ তিনি লাভ করেন স্বনামধন্য ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কার।
শঙ্খ ঘোষ ছিলেন কারো কাছে অভিভাবকসম, কারো কাছে অগ্রজের সমান, কারো কাছে পরম আশ্রয়স্থল। তাঁর কাব্যশিষ্য কবি জয় গোস্বামী বলেন, বাংলার সাহিত্যজগতের মহাবটবৃক্ষের পতন ঘটল। তরুণ কবি এবং লেখকের মাথার ওপরে পিতা এবং অভিভাবকস্বরূপ বিরাজ করেছিলেন তিনি। মাথার ওপর থেকে সেই আশ্রয় চলে গেছে। নিঃস্ব হলাম।
মৃত্যু ছাড়া সৃষ্টি অর্থহীন, জীবনও অর্থহীন। তাই একজন কবির মৃত্যু আমাদের চেতনাকে আলোকিত করে।
পরম সুহৃদ অশ্রুকুমার সিকদার বন্ধু শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘একজন কবির নিজস্ব নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায় একেবারে গোড়া থেকেই। আমাদের অস্তিত্বের একটা দিক আত্মিকতার কেন্দ্রে থাকে। অন্য একটা দিক থাকে বাইরে মুখ ফেরানো। বিশ্বগত আর ব্যক্তিগত সামনা-সামনি এসে দাঁড়ায়, সমন্বিত হয়। সমগ্র সত্তার স্বরূপে তিনি দেখেন বিশ্বকে, সমগ্র সত্তার মধ্যদিয়েই জীবনকে পেতে চান শঙ্খ ঘোষ। তাই স্বার্থের স্থানীয় সমীকরণের গ্িড তাঁকে আক্রান্ত করে, ন্যূব্জ করতে পারে না। তিনি আত্মসম্মানজাত উচ্চারণে লিখতে পারেন :
ঘর যায় পথ যায় প্রিয় যায় পরিচিত যায়
সমস্ত মিলায়
এমন মুহূর্ত আসে যেন তুমি একা
দাঁড়িয়েছ মুহূর্তের টিলার উপরে, আর জল
সব ধারে ধাবমান জল
প্লাবন করেছে সত্তা ঘরহীন পথহীন প্রিয়হীন পরিচিতিহীন
আর, তুমি একা
এত ছোটো দুটি হাত স্তব্ধ করে ধরেছ করোটি
মহাসময়ের শূন্যতলে …।
এই মহাসময়ে তাঁর প্রয়াণ তাই এক অসীম শূন্যতা এনে দিলো।’
কবির চলে যাওয়া বলতে কিছু নেই। একজন কবি সমগ্র জীবন দিয়ে তিনি যে অমর সৃষ্টিগুলো রচনা করেছেন, সেগুলো চিরকাল তাঁকে বাংলাভাষী পাঠকদের হৃদয়ে অমর হয়ে রাখবে। ২০২১ সালের করোনা মহামারি বাঙালির হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে শঙ্খ ঘোষের মতন প্রবাদপ্রতিম প্রতিভাকেও।
এই বছরের এপ্রিল মাসের শুরুতেই সর্দি-কাশির কারণে তাঁর করোনা পরীক্ষা করা হলে রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তবে কবি এই মহামারির মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হতে না চাওয়ায় বাড়িতেই নির্জন একাকিত্বে তাঁর চিকিৎসা হয়েছিল। কিন্তু এপ্রিল মাসের ২১ তারিখে করোনার সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধে কবি শঙ্খ ঘোষের পরাজয় ঘটে। তবে আমার মনে হচ্ছে অকালে চলে গেছেন প্রিয় কবি আমার। মানতে হবে জীবন থাকলে মৃত্যুও অনিবার্য। কিন্তু মৃত্যুতে কবি শঙ্খ ঘোষের মতন প্রতিভার সমাপ্তি ঘটে না।
ঋণ ও তথসুত্র : উইকিপিডিয়া, ইত্তেফাক, ইন্টারনেট এবং বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক,অধ্যাপক অশ্রুকুমার সিকদারএবং সৌভিক ঘোষাল-এর পেজ]।