লড়াই

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

বাসা থেকে আনা লাঞ্চবক্স খুলে পছন্দের তিতাকরলা ভাজি ও শিম-আলু দিয়ে রান্না রুইমাছের তরকারি পেটে ঢালতে ঢালতে রাশেদ সাহেব খেয়াল করলেন সবাই তার দিয়ে চেয়ে আছে। এমনভাবে তাকে দেখছে, যেন কোনো ভিনগ্রহবাসী লাঞ্চব্রেকে এই অফিসে উদয় হয়েছে। আরে ভাই, এত দেখার কী আছে। তিতাকরলা দিয়ে সিদ্ধচালের ভাত খাওয়া কি আর দেখেননি? নাকি লাঞ্চে আজকের মতোই সব সময় বাসমতি ভাত, গলদা চিংড়ি, রূপচাঁদা, ইলিশ সাবাড় করেন?অফিসের ম্যানেজার অবশ্য এই রাজকীয় মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিতে যথেষ্ট আবদার অনুরোধ করেছে-

স্যার, আপনার সম্মানে সামান্য আয়োজন। একটু মুখে না নিলে কষ্ট পাব।

ম্যানেজার সাহেব, আমার গিন্নির রান্না মুখে না নিলে তো আমিও কষ্ট পাব। হা হা হা…

রাশেদ সাহেব হাসতে হাসতে খাবারে মনোযোগ দেন। আর্থিক তদন্তের কাজে আজ সকালে এই অফিসে এসেছেন। সকাল থেকে দুপুর অব্দি যতটুকু কাগজপত্র দেখেছেন, তাতেই তার চোখকপালে। খাদকের দল জনগণের তহবিল ভালই সাবাড় করেছে। আইনগত বৈধতা থাকলে এদের জুতাপেটা করে শান্তি পেতেন। অনিয়মের একটা সীমা আছে। তাই বলে এক টাকার ভাউচার একশো টাকা? উন্নয়নের নামে কেনাকাটা তো কম হয়নি। সেগুলো গেল কোথায়? জলে ভেসে গেল, নাকি ছাগলে খেলো? ‘কাজির গরু, কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।’ কোনো ব্যাকরণবিদকে বলতে হবে, বাংলা বাগধারায় ‘পুকুরচুরি’ বাদ দিয়ে ‘সাগরচুরি’টা যুক্ত করে নিতে। এটা এখন সময়ের দাবি।

লাঞ্চ সেরে রাশেদ সাহেব আবার ফাইলপত্রে ডুব দিয়েছেন। সে সময় অফিসের ম্যানেজার এসে শুকনো মুখ করে জানালো, তাদের হেড অফিসের চেয়ারম্যান কথা বলতে চান। রাশেদ সাহেব একটু চিন্তা করার পর ব্যক্তিগত মোবাইলে কথা বলার আগ্রহ জানাতেই ম্যানেজারের উদ্বিগ্ন  চেহারায় হাসি খেলে গেলো। অল্পক্ষণ পরই রাশেদ সাহেবের মোবাইল বেজে ওঠে-

স্লামালেকুম। কেমন আছেন স্যার?

কী করে ভাল থাকি? উন্নয়নের একশ  কোটি তো বাতাসে উড়ছে!

বুঝেনই তো ভাই। কতজনকে খুশি করতে হয়।

সেটা বুঝতে পেরেছি। সবাইকে ভালই খুশি করেছেন। কিন্তু আমাকে তো খুশি করেননি।

এটা তো আমাদের পরম সৌভাগ্য। আপনাকে  সেবা করার সুযোগ কয়জনে পায়? শুধ ুএকবার ডিমান্ড জানান।

ডিমান্ড তো আছেই। সেটা পরে বলি। আগে বলেন, কাকে কত দিয়েছেন। তাহলে নিজের জন্য হিসাব কষতে সুবিধা হবে।

কী আর বলবো ভাই। উপরে উপরে সবাই সাধু। কিন্তু খাওয়ার সময় বোয়ালমাছ। অমুক এত, তমুক এত। আর ছোটখাটো  চোরবাটপার তো আছেই। তবে আপনার জন্য স্পেশাল ফান্ড। শুধু একবার মুখ  খোলেন।

এভাবে কথাবার্তা চলতে থাকে। রাশেদ সাহেব এক ফাঁকে  মোবাইল স্ক্রিনে নজর দিয়ে আবার কথায় ফিরে আসেন।  হেড অফিসের চেয়ারম্যান ঘুরেফিরে এক কথাতেই, একটা কিছু দাবি করেন। রাশেদ সাহেব ভণিতা করে বলেন-

ইদানিং অফিস থেকে বাসায় ফিরতে বেশ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়।

একটা ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি নেন। নিউ মডেলের কয়েকটি পোর্টে নেমেছে। বেশ লাক্সারিয়াস। আপনার জন্য একটা বুকিং দেই।

না ভাই। সেটার দরকার নেই। সরকারি ঋণে পছন্দের একটা গাড়ি নিয়েছি। সমস্যা অন্যরকম। সন্ধ্যার পর রাস্তায় এত চাপ থাকে, বাসায় পৌঁছাতে বারোটা বেজে যায়।

স্বাভাবিক। সারাদিন অফিস করে বাসায় ফিরতে এত ঝামেলা কার ভাল লাগে? অফিসের কাছেই একটা ফ্ল্যাট নিয়ে নেন। কত আর পড়বে, এক-দেড় কোটি?

এই সুযোগটাও নেই।  বৈবাহিক উত্তরাধিকারে শ্বশুরের অট্টালিকায় একটা ফ্ল্যাট দখল করেছি। সেটা ছেড়ে আমি আসতে চাইলেও গিন্নি পৈতৃক ভিটা ছেড়ে আসবে না। আপনি বরং ভাই অন্যভাবে একটা উপকার করেন।

শুধু একবার বলেন।

আমার অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত একটা ফ্লাইওভার নির্মাণ করে দেন। আমিসহ অফিসফেরত জনগণ যানজটের কষ্ট থেকে রেহাই পাবে।

মানে?

মানে আর কিছু না। হিসাবের ঠিকঠাক কাগজপত্র দিয়ে আমাকে খুশি করেন। তা না হলে আপনার ম্যানেজার জেলে যাবে। আর তার গুরুজনরা কী পুরস্কার পাবে, আদালতে সেটা সুরাহা হবে।

রাশেদ সাহেব কল কেটে ফাইলে নজর দেন। শয়তানটাকে ছাগল বানিয়ে বেশ আনন্দ পেলেও একটা চাপা ক্ষোভ মনে রয়ে যায়। দুর্নীতিবাজগুলি তামাম দুনিয়ায় সবাইকে নিজেদের মতো ভাবে। এদের কয়েকটার শেকড় টেনে উপড়ে ফেললেই অন্যদের লেজে টান পড়বে। তা না হলে  দেশটাকে মগের মুলুক বানিয়ে ছাড়বে এরা।

তদন্ত শেষ করে দু’দিন পর অফিসে ফিরতেই রাশেদ সাহেব তার পরিচালক স্যারের জরুরি তলব পান। দরজা ফাঁক করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই স্যার মাথা নেড়ে ভেতরে আসতে বলেন। স্যারকে আজকে একটু উদ্বিগ্ন ও গম্ভীর লাগছে। কোনো সমস্যা নাকি? তাদের এই অফিসকে তো প্রতিনিয়তই বিভিন্ন উটকো ঝামেলা-তদবির-থ্রেট সামাল দিতে হয়। নিশ্চয়ই আজ কিছু একটা হয়েছে। আপনমনেই এমন বিভিন্ন প্রশ্ন ও তার উত্তর খুঁজে যখন দিশেহারা, তখনই বড়কর্তা নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলেনÑ

রাশেদ সাহেব, আপনি আমার কষ্টিপাথরে যাচাই করা মানুষ। গত তদন্তে কি কোনো ভুল করেছেন?

না তো স্যার। এদের আর্থিক জালিয়াতির পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে। আজকে নোটিশ পাঠিয়ে আইনি পদক্ষেপ শুরু করবো।

কিন্তু ওরা তো বলছে, আপনার দাবি না মেটানোর কারণে তাদেরকে হয়রানি করতে চাইছেন।

এই বলে বড়কর্তা কয়েক মিনিটের একটি মোবাইল রেকর্ড শোনান। রাশেদ সাহেবের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসের চেয়ারম্যান ওই দিনের কথাবার্তা রেকর্ড করে তার কাটপিস পাঠিয়েছে। মনে করেছে, এভাবে হুমকি দিয়ে তাকে কোণঠাসা করে ফেলবে। এরা মনে হয় ভুলে গেছেÑ যেমন বুনোওল, তেমন বাঘা তেতুলও আছে। জানোয়ারদের সাথে লড়তে গেলে বর্ম ও অস্ত্র নিতে হয়, এটা রাশেদ সাহেব ভুলে যাবেন, তা তো হতে পারে না। তিনি মুচকি হেসে বলেন-

স্যার, এরা ট্রেইলার পাঠিয়েছে। কিন্তু আমার কাছে ফুলমুভি আছে।

রাশেদ সাহেব তার মোবাইল ঘেঁটে প্রায় দশ মিনিটের একটি রেকর্ড ভলিয়ম বাড়িয়ে পরিচালকের টেবিলের ওপর রাখেন। চোর-পুলিশের সংলাপ এগিয়ে চলে। শুনতে শুনতে দুজনের মধ্যেই চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। রেকর্ড শেষ হতেই রাশেদ সাহেবের বড়কর্তা অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন।

অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত ফ্লাইওভার? আপনি কমেডি লেখেন না কেন? হা হা হা …। শুনেন, তদন্ত রিপোর্টে একটা বাড়তি পয়েন্ট যুক্ত করে নেন- ‘তদন্ত কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদানের অভিযোগ।’ তাহলেই এদের থলের বেড়াল বের হয়ে মিউ মিউ করবে।

লালসা ও প্রলোভনের বিরুদ্ধে আরো একটি লড়াইয়ে শক্তব্যূহ নির্মাণ করতে পেরে রাশেদ সাহেবের মুখে প্রশান্তির ঝিলিক বয়ে যায়। দিনে দিনে এই সত্যটি তিনি আত্মস্থ করেছেন : শুধু নীতিকথায় কেউ সাধু হবে না। কুমিরের সাথে লড়তে গেলে হাঙর হতে হবে। তাহলেই এদের পেট ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়বে চাল-ডাল, ইট-সিমেন্ট, প্লট-ফ্ল্যাটের চোরাই খাতা।