সিডিএ সিলিমপুর আবাসিক এলাকা
৬০ বছর ধরে লেকটি সংরক্ষণ করা হচ্ছে : সভাপতি, আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতি
পরিবেশ আইনে লেক ভরাট নিষিদ্ধ: পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর
আমি প্লটের জন্য একজন আবেদনকারী মাত্র: সিডিএ সচিব
ভূঁইয়া নজরুল :
লেক ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিবকে (ভারপ্রাপ্ত)! ইতিমধ্যে সিডিএ চেয়ারম্যান তা অনুমোদন করে দিয়েছেন, এখন শুধু বোর্ড সভার অপেক্ষা। আগামী বৃহস্পতিবার বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই সভায় তা অনুমোদন পেলেই পাঁচ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দিতে আইনগত আর কোনো বাধা থাকবে না বলে জানা যায়।
১৯৬০-৬১ সালে পাহাড় ও সমতল ভূমি ঘেরা ১৯৬ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে তিন দফায় ১২০৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়। আর এসব প্লট বরাদ্দ দিতে এবং রাস্তা তৈরিতে এপর্যন্ত প্রায় আট দফায় আবাসিক এলাকার লে আউট পরিবর্তন করা হয়। সকল লে আউট প্ল্যানে আবাসিক এলাকার মসজিদের সামনে প্রায় তিন একর আয়তনের লেকটি রয়েছে। কিন্তু এখন লেকটির উত্তর অংশে একটি পাঁচ কাঠার প্লট তৈরি করা হচ্ছে। এবিষয়ে সিডিএ সিলিমপুর আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি আরজু খান বলেন, ‘লেকটি ৬০ বছর ধরে সংরক্ষিত হয়ে আসছে। এই লেকটি আবাসিক এলাকার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। লেকের পাড়ে আবাসিক এলাকার মানুষের বিনোদনের জন্য ওয়াকওয়ে এবং বসার কিছু স্থাপনা নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এখন এই লেক ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেয়ার উদ্যোগ কখনো মঙ্গলজনক হবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘২০১৩ সালে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এই লেক ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্য আবেদনপত্রও বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ আইন ও আমাদের দাবির মুখে পিছু হটতে হয়েছিল। যদি এবারো লেক ভরাট করে কাউকে প্লট বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয় তাহলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেবো।’
প্লট বরাদ্দ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, এর আগে সিডিএ একটি খেলার মাঠ এবং পার্কের জায়গায় প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। এভাবে উন্মুক্তস্থানগুলো বরাদ্দ দিয়ে আবাসিক এলাকাটিকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলছে। ইতিমধ্যে সিডিএ চেয়ারম্যানের কাছে আমরা লিখিতভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছি।’
লেক ভরাট করে কোনোভাবেই প্লট বরাদ্দ দেয়া যাবে না জানিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন,‘জলাধার সংরক্ষণ আইনে কোনোভাবেই লেক ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেয়ার এখতিয়ার নেই। আর যদি দিতেই হয় তাহলে ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে হবে। আর জলাধারের শ্রেণী পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
প্লট বরাদ্দ দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিএ’র তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ এ এম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে আমি শুধু স্বাক্ষরের মালিক। সিডিএ’র উর্ধতনগণবলেছেন লেকের ওখানে প্লট তৈরি করার জন্য। সেই হিসেবে লেকের ওখানে প্লটের ডিজাইন করা হচ্ছে।’
লেকে প্লট নির্মাণ করা যায় কিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন সিলিমপুর আবাসিক এলাকার দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু ওখানে প্লট তৈরি করা হয়নি। এমনকি ২০১৩ সালে লেক ভরাট করে প্লট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তীতে তা থেকে সরে আসে সিডিএ।’
এবিষয়ে সিলিমপুর আবাসিক এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহি প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাসান বলেন, আমাকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নির্দেশ দিয়েছেন লেকের ওখানে প্লটের ডিজাইন করতে। আমি সেই অনুযায়ী ফাইল রেডি করছি। আগামী ২০ আগস্ট বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে এবং সেখানে তা উপস্থাপন হবে।’
লেক ভরাট করে প্লট কেন?
সিলিমপুর আবাসিক এলাকায় এখনো অনেক খালি জায়গা রয়েছে। সেসব জায়গায় প্লট তৈরি করা যায়। কিন্তু লেক ভরাট করে প্লট কেন এমন প্রশ্ন করা হলে সিডিএ’র একাধিক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, লেকের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে একটি প্লট নিতে চেয়েছেন সিডিএ’র ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল আলম চৌধুরী। সচিবের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই লেক ভরাট করে প্লট বরাদ্দ দেয়ার প্রক্রিয়া নেয়া হচ্ছে।
এবিষয়েসিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন,‘সিডিএ’র বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সচিব একটি প্লটের জন্য আবেদন করেছেন এবং সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান তা অনুমোদন করে প্লট দেয়ার প্রক্রিয়া করতে বলেছেন। প্রক্রিয়ার আলোকে বোর্ড সভায় অনুমোদন দিলে প্ল্যানিং বিভাগ লেআউট পরিবর্তন করে প্লট তৈরি করবেন।’
লেক ভরাট করে প্লট দেয়ার আবেদন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিএ’র ভারপ্রাপ্ত সচিব সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমি বর্তমানে সিডিএ’র ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করছি। স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন সময়ে প্লটের জন্য আবেদন করি। তা চেয়ারম্যান অনুমোদন দিয়েছেন এবং বোর্ডসভায় অনুমোদন দিলে প্লট বরাদ্দ দেবে, অন্যথায় নয়। এখানে আমি একজন আবেদনকারীমাত্র।’
কিন্তু লেক ভরাট করে প্লট নিতে চাচ্ছেন কেন? এপ্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি একজন আইনের লোক হিসেবে লেক ভরাট করে প্লট দেয়ার কথা কেন বলবো?’
আপনি কি কোনো স্থান উল্লেখ করেননি? এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,‘স্থান উল্লেখ করেছি। তবে কোন স্থানে দিতে বলেছি তা আমার মনে নেই।’
এবিষয়ে সিডিএ সিলিমপুর আবাসিক এলাকা কল্যাণ সমিতির সভাপতি আরজু খান বলেন, ‘সিডিএ’র সচিবকে প্লট বরাদ্দ দেয়ার জন্য অনেক জায়গা রয়েছে। উনাকে যদি প্লট বরাদ্দ দিতে চায় সেজন্য অনেক খালি জায়গা রয়েছে। কিন্তু লেকের জায়গায় কেন?
সিডিএ’র পরিকল্পনা শাখার দায়িত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট পরিকল্পনাবিদ শাহীনুল ইসলাম খান। প্রধান এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ‘লেক ভরাট করে আমরা আগেও প্লট বরাদ্দ দিতে দেইনি। এবারো তা করতে দেয়া হবে না। কারণ, লেকটি হলো আবাসিক এলাকার সৌন্দর্য। অনেক এলাকায় এখন লেক তৈরি করতে হয়, সেখানে লেক ভরাট করে প্লট করতে দেয়া হবে না।’
বিশেষ প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া
বিশেষভাবে প্লট বরাদ্দের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায়, কোনো আবেদনকারী প্লটের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করবেন। চেয়ারম্যান তা গ্রহণ করলে প্লট দেয়ার প্রক্রিয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের বলবেন। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ফাইল রেডি করে বোর্ড সভায় অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করবেন। বোর্ড অনুমোদন দিলে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়ে যাবে। তবে যদি নতুন প্লট তৈরি করতে হয়, সেক্ষেত্রে বোর্ড সভায় বলে দেয়া হয় প্লট তৈরি করে বরাদ্দ দেয়ার জন্য। তখন পরিকল্পনা বিভাগ লে আউট পরিবর্তন করে প্লট তৈরি করে এবং সেই প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়।