শিবু কান্তি দাশ
সামনেই প্রেরণার পিএসপি পরীক্ষা। পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সে। প্রাইভেট টিউটর প্রতিদিন একগাদা হোমটাস্ক দিয়ে রাখে। ইশকুলের টিচারও একই। প্রেরণার ঘুমানোরও কোন সুযোগ নেই। খাওয়া-দাওয়াতেও তার মন নেই। মা তবু জোর করে খাইয়ে দেয়। অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে। সকালে মা ডাকতে-ডাকতে হয়রান। উঠতেছি তো মা, উঠতেছি তো মা বলে প্রেরণা আড়মোড়া দিয়ে ঘুমের রেশটা ভাঙাতে চায়। কিন্তু ঘুমের পরি যেন তাকে ছাড়ে না।
সেদিন ঘটল এক কা-। শুক্রবার ইশকুল বন্ধ।প্রেরণা মাকে বলল, আজকে আমাকে ডাকবে না। যতক্ষণ আমার ঘুম না ভাঙে। মাও আর ডাকাডাকি করছে না। মা তার রান্নাবান্না, নাস্তা তৈরি করা এসবে ব্যস্ত। এদিকে কোত্থেকে এক বেড়ালছানা প্রেরণার বিছানায় ঘুমিয়েছে কে জানে। সকাল হতেই বেড়ালছানাটি মিউ-মিউ করে ডাকছে আর বারবার প্রেরণার গায়ে আলতো করে পা দিয়ে আঘাত করছে। কতক্ষণ এভাবে সময় গেছে কে জানে। হঠাৎ রেগে ওঠে প্রেরণা, মা তোমাকে না বলেছি আজ আমি ঘুমাব।
মা শুনে তো অবাক। কই আমি তো তোকে একবারও ডাকি নাই। মা এ কথাটা বলে তার কাজে আবার মনোযোগ দেয়। বেড়ালছানাটিও কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আবার প্রেরণাকে তার নরম তুলতুলে পা দিয়ে আঘাত করে আর মিউ-মিউ করে। মা দেখে তো কি হাসবে, না কি করবে। নিজে নিজে বেড়ালছানার কা- দেখে এক রকম ভালোলাগা বোধে নিজেই খুশিতে টগবগ করছে।
এক সময় প্রেরণার ঘুম ভেঙে যায়। মা দাঁড়িয়ে আছে দেখে মার দিকে তাকিয়ে থাকে প্রেরণা। এবার মা না হেসে আর পারে না। মার হাসি দেখে প্রেরণাও একটু হাসে। এমন সময় আবার মিউ-মিউ করে ডেকে ওঠে বেড়ালছানাটি। প্রেরণা পাশ ফিরে দেখে তো অবাক। মা মা বেড়ালছানা! দেখো না কি সুন্দর।
প্রেরণা এবার বেড়ালছানাটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ওকে কোলে করে বাইরে দাওয়ায় বসে বারবার আদর করে যাচ্ছে। বেড়ালছানাটিও যেন তার মাকে পেয়েছে। তার মা কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে। নাস্তা করার সময় বেড়ালছানাকেও নাস্তা খাইয়ে দেয় প্রেরণা। মুহূর্তে ভাব হয়ে গেল দুজনের মধ্যে। প্রেরণা যেখানে যাচ্ছে পেছন-পেছন মিউ-মিউ করে গানম্যানের মতো পাহারা দিয়ে যাচ্ছে সেও। সেদিন বেড়ালছানাটির একটি নামও দিয়ে দেয় প্রেরণা। লিলি। ছানাটিকে লিলি বলে ডাকলে মিউ-মিউ করে গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। কত আপন লিলি। ইশকুলে যাওয়ার সময় লিলিকে মায়ের কাছে রেখে যায় প্রেরণা।
মা, লিলিকে দেখো। ঘরের বাইরে যেতে দেবে না।
আচ্ছা, আচ্ছা। তুই ইশকুলে যা। মা জবাব দেয়।
লিলি আর প্রেরণা দুজনের সখ্যতায় বাবা-মাও খুশি। বাবা তো সেই সকালে বেরিয়ে যায়। ফেরে রাতে। তখনও লিলি প্রেরণার সাথে ঘুরঘুর করে। লিলির জন্য ডাইনিং টেবিলের খাবারের এঁটোগুলো যতœ করে তুলে রাখে। মাছের কাঁটাকুটা, মাংসের হাড়, সবকিছু। লিলিকে যখন খেতে দেয় কি স্ন্দুর করে তৃপ্তির সাথে খায়। প্রেরণা তা দেখে খুশি হয়।
লিলি এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়ায়। মাঝে-মাঝে মা লিলিকে এটা-সেটা খেতে দেয়। খেতে পেলে লিলি খুব খুশি।
লিলিকে নিয়ে প্রেরণার ভাবনার অন্ত নেই। মাও লিলিকে খুব ভালোবাসে। লিলি যেন মায়ের আরেকটা সন্তান। সারাক্ষণ লিলি … লিলি। অনেক রাতে প্রেরণার বাবা বাসায় ফেরে। বাবা খেতে বসলে লিলি করে ডাক দেয়। লিলি হাজির। মিউ-মিউ করে আশপাশে ঘুরঘুর করে। মাঝেমাঝে লিলিকে নিয়ে বাবাও খেলা করে। প্রেরণা এসব কিছুই দেখে না। সে তো ঘুমিয়ে। সবাই ঘুমিয়ে গেলে প্রেরণার পাশে গিয়ে ঘুমায় লিলি।
হঠাৎ প্রেরণার নানির খুব অসুখ। খবর পেয়ে প্রেরণার মা আর স্থির থাকতে পারে না। মায়ের অসুখে কেউ কি স্থির থাকতে পারে ? এখনই বের হতে হবে। প্রেরণাও যাবে। কিন্তু লিলিকে কি করা যায়! প্রেরণা বুদ্ধি করে মার সাথে। বাবাকে ফোন করে বলে দেন কিছ ুশুঁটকি ও কাঁচামাছ বাজার থেকে নিয়ে আসার জন্য। পাশের বাসার এক আন্টিকে রাজি করায় লিলিকে দেখা শোনার জন্য। বাবার আনা কাঁচামাছগুলো ভেজে নিয়ে শুঁটকিসহ আন্টিকে দেয়া হয় লিলির খাবার হিসেবে।
প্রেরণার খুবই মনখারাপ। লিলিকে নিয়ে কত কথা। কথা ছিল দুদিন থেকে চলে আসবে ওরা। কিন্তু প্রেরণার নানির অসুখ বেড়েই চলছে। হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এদিকে চারদিন হয়ে গেল। প্রেরণার আর মন টেকেনা। বাবা-মাকে তাড়া দেয় বাসায় ফিরতে। লিলি যে একা। বাবা-মাও সে কথাতে চিন্তিত।
সেদিন বিকেলে বাসায় পৌঁছে ঘরের দরজা খুলেই দেখে লিলি নিথর পড়ে আছে। তার গায়ে কয়েকটি কামড়ের দাগ। একটা জায়গায় ছিঁড়ে লাল হয়ে আছে। চামড়া ওঠে গেছে। প্রেরণার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে। মা, বাবা, দেখো, দেখো আমার লিলির কি অবস্থা। তারাও অবাক। লিলিকে কোলে নিয়ে কত না আদর দিয়ে যাচ্ছে প্রেরণা। মা তাড়াতাড়ি গরমজলের ভাব দেয়। ঔষধ লাগিয়ে দেয়া হয়। তাতেও লিলি চোখ খোলে না। শুধু একটু-একটু নিশ্বাস নিচ্ছে।
প্রেরণা তো হাউমাউ করে কেঁদেকেটে একাকার। লিলি চোখ মেলে না তাকানো পর্যন্ত সে কিছু খাবে না। মেয়ের এ অবস্থা দেখে বাবা লিলিকে নিয়ে রিকশা করে পশু হাসপাতালে ছুটে রাত একটায়। চিকিৎসক দেখে লিলিকে কিছ ুঔষধ দিয়ে দেয়। নিয়ম করে খাওয়াতে বলে। বাসায় ফিরে লিলিকে যখন শুয়ে দেয়া হয় তখন অনেক কষ্টে একটু করে মিউ করে ওঠে। হয়ত লিলির একটু ভালো লেগেছে এবং বুঝেছে সে তার সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত প্রেরণা বা ওর মা-বাবার মনখারাপ থাকবে। লিলির এ টুকুতে ফিক করে হেসে ওঠে প্রেরণা। মা-বাবাও যেন একটু স্বস্তি পেলেন। সুস্থ হয় উঠবে তো লিলি ? আবার ডাকবে তো মিউ-মিউ।