লাল পলাশের গান

সুব্রত চৌধুরী »

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই শুভ্রর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভাষার মাস উপলক্ষে পাড়ার সংগঠনের উদ্যোগে একুশদিন ব্যাপী যে অনুষ্ঠানমালা হয় তা সফল করার দায়িত্ব অনেকটা তার ওপরেই বর্তায়।
ভাষার মাসে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সাল, প্রভাতফেরি – সব কিছুতেই তার সম্পৃক্ততা থাকা চাই। আর এসব করতে গিয়ে সে হাঁফিয়ে উঠলেও রণে ভঙ্গ দেয় না।
শুভ্র ক্লাশের ফার্ষ্ট বয় তাই পড়ালেখায় সে বরাবরই সিরিয়াস। বাবা মাঝে মধ্যে মায়ের কাছে অনুযোগ করে, ‘ছেলেটা বোধহয় গোল্লায় গেল’।
কিন্তু মা ঠিকই ডিফেন্সিভ খেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কারন মা ভালো করেই জানে পড়ালেখার ব্যাপারে শুভ্র কতটুকু সিরিয়াস। আর শুভ্রর নেতৃত্বের গুনাবলীতে মা-ও খুব গর্ববোধ করে। পাড়ার বৌ -ঝিরা যখন কথাচ্ছলে শুভ্রর নেতৃত্বের প্রশংসা করে তখন গর্বে তাঁর বুকের ছাতি ফুলে ওঠে, যদিও চেহারায় তিনি তা প্রকাশ করেন না।
শুভ্রর গানের গলাও বেশ ভালো। পাড়ার যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ থাকবেই। একুশের অনুষ্ঠানে লিড ভোকালিস্টের দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। প্রতি বছর দরাজ গলায় তার গাওয়া একুশের গানগুলো সবাই প্রাণভরে উপভোগ করে।
একুশের অনুষ্ঠান আয়োজনে শুভ্রর মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকে তার ছোট‘কা। গ্রামের বাড়ি থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির আগে দিন কয়েকের জন্য শহরে চলে আসে। ছোট‘কা আসাতে শুভ্রর কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায় । আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে ছোট‘কার হাতের কাজ খুব ভালো। তাই আঁকিবুকির কাজটা ছোট‘কাই সামাল দেয়। রাস্তার মোড়ে আলপনা আঁকা, পোস্টার তৈরির কাজ -এসব ছোট‘কাই সামাল দেয়।
এবছর শুভ্রর মাথায় নতুন একটা আইডিয়া খেলা করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সে বর্ণমালার মিছিলের আয়োজন করতে চায়। এই ব্যাপারে ছোট‘কার পরামর্শ নিতে
তার ভেজানো দরজায় টোকা মারে শুভ্র ।
ভেতরে আসতে পারি ছোট‘কা?
আয়।
শুভ্র ঘরের ভেতর ঢুকে খাটের কোণায় বসে।
এবার বল তোর একুশের প্রস্তুতি কেমন?
ভালোই। এবছর নতুন একটা আইডিয়া মাথায় খেলছে।
কী?
বর্ণমালার মিছিল করলে কেমন হয়?
কখন?
একুশে ফেব্রুয়ারির আগের দিন।
সকালে না বিকেলে?
বিকেলে
আইডিয়াটা মন্দ না।
তোমার কাজ বেড়ে যাবে আর কি।
ওটা কোন ব্যাপার না, আমি ঠিকই ম্যানেজ করে নেবো।
ছোটকার সম্মতি পেয়ে শুভ্রর আনন্দ যেন আর ধরে না। সে মনে মনে কল্পনা করতে থাকে পাড়ার সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত বর্ণমালার মিছিলে পাড়ার ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন বর্ণমালা হাতে নিয়ে অংশগ্রহণ করছে। বর্ণমালার মিছিল যখন সদর রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে তখন রাস্তার দু’পাশের উৎসুক জনতা হাত নাড়িয়ে তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। শুভ্রর আনন্দ যেন আর ধরে না। খুশিতে সে চিৎকার করে ওঠে, হিপ! হিপ! হুররে!
দেখতে দেখতে একুশে ফেব্রুয়ারি দরজায় কড়া নাড়ে।
শুভ্রর ব্যস্ততা আগের চাইতে আরো বেড়ে যায়। তার নিবিড় তদারকিতে একুশের দু’একদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে একুশের আলপনা আঁকা, একুশের পোস্টার সাঁটানো।
একুশের প্রভাতফেরির ফুল সংগ্রহ করার দায়িত্বও শুভ্রর। সেদিন বিকেল বেলা সে বন্ধুদের সঙ্গে পলাশ ফুল সংগ্রহের জন্য নদীর পাড়ে যায়। তারা দু’তিনজন তরতর করে গাছের মগডালে চড়ে বসে। মনের আনন্দে থোকা থোকা পলাশ ফুল ছিঁড়ে গাছের নিচে ফেলতে থাকে, আর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে সাঁজি ভরে। ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে শুভ্র ছোট‘কার সদ্য লেখা ছড়ার দু’টি লাইন আওড়াতে থাকে-
‘একুশ আমার লাল পলাশে ভায়ের তাজা রক্ত
থরো থরো কেঁপে ওঠে পাকি শাহীর তখতো।
ছড়ার এই দু’টি লাইন শুভ্রর বেশ মনে ধরেছে। তাই সে বারবার লাইন দু’টি আওড়াতে থাকে, ভিতরে ভিতরে উওেজনায় সে টগবগ করে ফুটতে থাকে। ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাছের ডালটা তাকেসহ নিয়ে মড়মড় করে ভেঙে পড়ে । মাটিতে পড়েই শুভ্র জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। যখন তার জ্ঞান ফিরে আসে তখন সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে। আস্তে আস্তে চোখ মেলে দেখে মা-বাবার উদ্বিগ্ন মুখ। তার কানে বাজতে থাকে মার উদ্বেগ মাখা কন্ঠ, শুভ্র, খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা?
শুভ্র আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ ।
শুভ্র চারপাশে চোখ বোলাতে থাকে, দেখে বেডের কোণায় উদ্বিগ্ন চেহারায় ছোট‘কা দাঁড়িয়ে, তার সাথে ক্ষনিকের জন্য
শুভ্রর দৃষ্টি বিনিময় হয়। তারপর তার চোখ জোড়া আবার মুদে আসে। শুভ্রর কানের মাঝে তখনো বাজতে থাকে –
‘একুশ আমার লাল পলাশে ভায়ের তাজা রক্ত
থরো থরো কেঁপে ওঠে পাকি শাহীর তখতো।