আমীন আল রশীদ »
গত শনি ও রবিবার রাজধানী ও বড় বড় শহরের বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন ও লঞ্চ টার্মিনাল এবং সোমবার সকালেও ফেরিঘাটের যেসব চিত্র গণমাধ্যমে এসেছে, তাতে যে কারও মনে হতে পারে, বুঝি বা ঈদের ছুটি ঘোষিত হয়েছে অথবা দুদিন বাদেই ঈদ। কেননা, প্রতি বছর ঈদের সময়ই বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে ঘরমুখো মানুষের এরকম উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়। কিন্তু না, ঈদের ছুটি নয়। গত বছরের মতো করোনাকালীন সাধারণ ছুটিও নয়। বলা হচ্ছে লকডাউন।
লকডাউন মানে সবকিছু বন্ধ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোনো নিষেধ। লকডাউন মানে জরুরি সেবা ছাড়া অন্য পেশার মানুষের অফিস বন্ধ অথবা সীমিত লোকবল দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস বা কলকারখানা চালু। লকডাউন মানে গণপরিবহনও বন্ধ। শুধু অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমের গাড়ি চলবে। কিন্তু করোনার ঊর্ধ্বমুখী গ্রোত প্রতিরোধের জন্য সরকারের লকডাউন ঘোষণার পরই ঢাকা ছাড়তে মানুষের যে ভিড় লক্ষ করা গেছে এবং নামে ‘লকডাউন’ হলেও আদতে এর ফলাফল কী হবে—তা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
করোনা প্রতিরোধের প্রধান শর্ত হলো বাইরে বের হলে মুখে মাস্ক পরে থাকা এবং পরস্পরের থেকে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। কিন্তু বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে হাজার হাজার মানুষ যেভাবে গায়ে গা লাগিয়ে গণপরিবহনে উঠেছেন এবং যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করেছেন, সেখানে শারীরিক দূরত্বের কোনও বালাই ছিল না। টেলিভিশনের খবরে দেখা গেছে, ওই ভিড়ের মধ্যে অনেকের মুখে মাস্ক নেই। অর্থাৎ যে করোনা প্রতিরোধের জন্য লকডাউন দেওয়া হলো, সেই করোনা আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার সব আয়োজনই সম্পন্ন হয়েছে বাস, লঞ্চ ও রেলস্টেশনে। যারা এভাবে গাদাগাদি করে ঢাকা বা বড় শহর ছাড়লেন, তাদের মধ্যে যদি ২০ শতাংশ মানুষের শরীরেও করোনাভাইরাস থেকে থাকে, তাহলে তারা এই দুদিনে আরও কত মানুষকে সংক্রমিত করলেন?
করোনায় সংক্রমিত ছিলেন না, কিন্তু নগর ছাড়তে গিয়ে এরকম ঠাসাঠাসির মধ্যে যদি সত্যিই বিপুল সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়ে থাকেন এবং বাড়ি যাওয়ার পরে যদি তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন, তারা কোথায় চিকিৎসা করাবেন? জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোয় করোনার কি পর্যাপ্ত চিকিৎসা আছে? কারও যদি করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন হয়, তারা কি সহজে সেখানে পরীক্ষা করাতে পারবেন? জেলা-উপজেলা শহর তো দূরে থাক, খোদ রাজধানীর বড় বড় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও যখন সিট ফাঁকা নেই, চিকিৎসা পাওয়া কঠিন, অক্সিজেন সংকট, এমনকি রোগী ভর্তি করাও যাচ্ছে নাÑতখন এই লকডাউনের সুযোগে বাড়ি যেতে গিয়ে যদি নতুন করে আরও কয়েক হাজার মানুষ করোনায় সংক্রমিত হন এবং তারা যদি আরও অনেককে সংক্রমিত করতে থাকেন, তাহলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
কেন লকডাউন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এভাবে দলবেঁধে ঢাকা ছাড়তে উদ্যত হলো? ঢাকায় থাকলে করোনা হবে আর ঢাকার বাইরে গেলে নিরাপদ? কারা ঢাকা ছাড়লেন? যারা গিয়েছেন তাদের সবাই কি দিনমজুর বা তাদের নিয়মিত পেশা নেই? তারা কোন আতঙ্কে বা আশঙ্কায় ঢাকা ছাড়লেন? লকডাউন হলেই মানুষকে ঢাকা ছাড়তে হবে কেন? এখানে কি তারা নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না?
লকডাউন ঘোষিত হয়েছে এক সপ্তাহের জন্য। কিন্তু মানুষ কি ধরেই নিয়েছে যে এটি দ্বিতীয় দফায় আরও এক সপ্তাহ এবং এরপর ধারাবাহিকভাবে রোজার ঈদ পর্যন্ত বাড়বে? যেহেতু রোজার ঈদ পর্যন্ত বাড়বে এবং গণপরিবহন বন্ধ থাকলে তখন বাড়ি যাওয়া যাবে না, সেই আতঙ্কে কি অনেকে নগর ছেড়েছেন?
লকডাউন মানে বিধিনিষেধের কড়াকড়ি। মানুষ কি কড়াকড়ি চায় না? তারা কি চায় এই সুযোগে জেলা উপজেলা শহর বা গ্রামে পরিবার পরিজনের সঙ্গে ছুটির আনন্দে দিনগুলো কাটাবে? করোনা এবং লকডাউন কি শুধু রাজধানীবাসীর জন্য? যারা দলবেঁধে ঢাকার বাইরে গেলেন, তারা কি ভাবছেন যে, সেসব জায়গায় লকডাউন হবে না বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতটা কঠোর হবে না?
যেদিন লকডাউনের প্রজ্ঞাপন হলো সেদিন দুপুরে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, তারা লকডাউন চান না। তাদের দাবি, গত বছরের সাধারণ ছুটিতে তাদের যে ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ফলে নতুন করে লকডাউন দিলে সেই ক্ষতি আরও বাড়বে। বিশেষ করে আর কিছু দিন পরেই যেহেতু ঈদের কেনাকাটা শুরু হওয়ার কথা, সেটি ব্যর্থ হলে তাদের অনেককে পথে বসতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি করোনায় প্রতিদিন সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায় এবং মৃত্যু যদি একশ’ কিংবা তারও বেশি হতে থাকে, তাহলে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সামনে আর বিকল্প কী পথ ছিল?
বলা হচ্ছে, যেসব অফিস ও কলকারখানা চলবে, তারা নিজস্ব ব্যবস্থায় কর্মীদের আনা-নেওয়া করবেন। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানের কি নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা আছে? লকডাউনের প্রথম সকালে টেলিভিশনের খবরে দেখা গেছে, অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, গণপরিবহন বন্ধ কিন্তু অফিস খোলা। কীভাবে যাবো আপনি বলুন।
অদ্ভুত বিষয় হলো, ব্যাংক খোলা থাকবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। প্রশ্ন হলো, মাত্র আড়াই ঘণ্টায় কি একটি ব্যাংকের সব লেনদেন সম্ভব? অল্প সময় খোলা রাখলে কি গ্রাহকরা ব্যাংকে কম যাবেন নাকি করোনা এই সময়ে কম ছড়াবে? বরং উল্টো হওয়ার শঙ্কা বেশি এ কারণে যে, যেহেতু অল্প সময় ব্যাংক খোলা থাকবে, অতএব একসঙ্গে অনেক লোক ভিড় করবেন এবং সেখানে শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘিত হওয়ার শঙ্কা থাকবে।
কোনোভাবেই জনগণের একটি বড় অংশ স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মানা তো দূরে থাক, মাস্কই পরে না বা পরতে আগ্রহী নয়। গণমাধ্যমে প্রতিদিন এই বিষয়ে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চললে মানুষ তা সামান্যই পাত্তা দেয়। জনগণের একটি বড় অংশের মনে এখনও এই ধারণা বদ্ধমূল যে, করোনা বড়লোকের রোগ; গরিবের হবে না। ফলে স্বাস্থ্যবিধি বা মাস্ক পরার আহ্বানে তারা সাড়া দিতে অনাগ্রহী। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সত্যিই সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়েছে এবং স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, পরিস্থিতি দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুতরাং, এ অবস্থায় লকডাউনের বিকল্প কি কিছু ছিল?
গণপরিবহন বন্ধ। কিন্তু বইমেলা চলবে। মেলা প্রাঙ্গণের আশপাশে যাদের বাড়ি, তারা হেঁটে যেতে পারবেন। বাকিরা কীভাবে যাবেন? লকডাউন যদি এক সপ্তাহের পরে আর না বাড়ানো হয়, তাহলে এক সপ্তাহ পর থেকে মেলা হয়তো জমবে। কিন্তু তখন রোজা শুরু হয়ে যাবে। তাছাড়া মেলার নির্ধারিত সময়ও শেষ হয়ে যাবে। তার মানে এই লকডাউনের সাতদিনে মেলায় বই বিক্রি হবে সামান্যই। তাহলে লকডাউনের মধ্যে বইমেলা চালু রাখার যুক্তিটা কী? ব্যবসায়ীরা কি মনে করছেন যে, যেহেতু এবার এমনিতেই মেলা জমেনি বা বই বিক্রি কম হয়েছে, তাই লকডাউনে সাতদিনে সামান্য কিছুও যদি বিক্রি হয়, তাতেই বা মন্দ কী?
গত বছরের সাধারণ ছুটির সময়ে গরিব ও দিনমজুরদের জন্য সরকারের তরফে খাদ্য সরবরাহের একটা উদ্যোগ ছিল। এবার সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই। তাহলে গরিব ও দিনমজুররা এই লকডাউনের সময়ে কী খাবেন?
পরিশেষে, মানুষ যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, অন্তত মাস্কটা না পরে, তাহলে সাতদিন কেন, এক মাস লকডাউন দিয়েও কোনও লাভ নেই।
লেখক : সাংবাদিক