রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংকট বাংলাদেশকে এক অদৃশ্য আংটায় ঝুলিয়ে রেখেছে। বলা যায়, এ যেন গলায় আটকে থাকা কাঁটা। বাংলাদেশ এ উপদ্রব সইবার জন্য আর প্রস্তুত নয়। অথচ এর সঙ্গে মিয়ানমারের সকল শিষ্টাচার বহির্ভূত একধরনের একগুঁয়েমি জড়িয়ে আছে। আর বাংলাদেশ মানবতার বোঝা বয়ে চলেছে সীমিত সাধ্যের ভেতরে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে অক্লান্ত প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রায় অচল অবস্থার মধ্যে গত মঙ্গলবার কিঞ্চিৎ আলোর রেখা দেখা গেছে যেন সুড়ঙ্গের ওপারে। ওইদিন চীনের মধ্যস্থতায় প্রথম ভার্চুয়াল আলোচনায় মিলিত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। কূটনৈতিক পরিভাষায় এটিকে আশার সঞ্চার বলা হচ্ছে। কেননা একেবারে পাথুরে নীরবতার বাইরে আলাপ-আলোচনার দ্বারোদ্ঘাটন তো হচ্ছে। এই বৈঠকে দেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন, বেইজিং থেকে চীনের উপমন্ত্রী লুও ঝাওহুই এবং মিয়ানমারের নেপিডো থেকে সে দেশের আন্তর্জাতিক সহায়তাবিষয়ক উপমন্ত্রী হে দো সুসান অংশ নেন। ঢাকা থেকে চীনা রাষ্ট্রদূত ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতও এই ভার্চুয়াল আলোচনায় মিলিত হন।
বৈঠকের ফলাফল থেকে আপাতত বড় কোনো সুফলপ্রাপ্তি ঘটেনি। তবে উভয়পক্ষ থেকে ইতিবাচক মনোভাব পোষণের কিছু আভাস পাওয়া গেছে। মিয়ানমার প্রত্যাবাসন বিষয়টিকে কিছুটা ধোঁয়াশার ভেতর রেখে দিতে চাইছে বিচ্ছিন্নভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রসঙ্গ এনে। বিপরীতে বাংলাদেশ বলছে, বিচ্ছিন্ন নয়, গ্রামভিত্তিক জনসংখ্যার অনুপাতে প্রত্যাবাসন শুরু হোক। একসঙ্গে কিছু লোক পরস্পর পরস্পরকে চেনে এবং একই গ্রাম থেকে এসেছে , এভাবে যদি এগিয়ে যাওয়া যায়, সেটা অনেক বেশি কার্যকর হবে, বাংলাদেশ বলেছে। মিয়ানমার বিষয়টিতে প্রবেশে অনীহা দেখিয়ে বলতে চাইছে, এখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গাকে যাচাই-বাছাই করে পাঠানো হয়েছে, তাদের যুক্ত করে বিক্ষিপ্তভাবে প্রত্যাবাসন শুরু হোক। এই জায়গায় আলোচনার গতি স্থির হয়ে থাকলেও পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সই হওয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে যেন সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া এগিয়ে চলে, নতুন প্রসঙ্গ এনে যাতে দেরি করা না হয়, এ বিষয়ে অপর দুই পক্ষকে ঐকমত্যে আনতে পেরেছেন। বিশেষ করে চীনের মনোভাব এক্ষেত্রে ইতিবাচক থাকার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এ ধারায় সিদ্ধান্ত হয়েছে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ওয়ার্কিং কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক হবে, যার ব্যাপ্তি বাড়বে। ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর আবার পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হবে।
এ কথা সত্য যে, মিয়ানমার আন্তর্জাতিক জনমত ও জাতিসংঘের প্রস্তাবের প্রতি সাড়া দিচ্ছে না। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা।
চীন এবার বৈঠকে যুক্ত হয়েছে, এটি আমাদের জন্য ভালো সংবাদ। বৃহৎশক্তি হিসেবে চীন এতদঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেবে, বাংলাদেশের মানুষ তা চায়। ভারত রাশিয়া জাপানকে এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে বাংলাদেশের আরও সক্রিয় কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত আমাদের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে পারে।
মতামত সম্পাদকীয়