রোহিঙ্গা সংকটের জরুরি সমাধানের লক্ষ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে চতুর্থবারের মতো প্রস্তাব পাশ হয়েছে। ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি উত্থাপন করে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে। প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পড়ে ১৩২, বিপক্ষে ভোট দিয়েছে ৯টি, ভোটদানে বিরত থাকে ৩১ দেশ। প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় রাশিয়া ও চীন, জাপান এবং ভোট দেয়নি নিকট প্রতিবেশী দেশ ভারত, সার্কভুক্ত দেশ নেপাল ও শ্রীলঙ্কা। এবারের প্রস্তাবটিতে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের সাময়িক আদেশ, আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের তদন্ত শুরু, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু নির্যাতন-নতুন এই বিষয়গুলি যুক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান, সমস্যাটির মূল কারণ খোঁজা, প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি পূর্বক টেকসই প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রভৃতি সন্নিবেশিত রয়েছে।
এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে চীন, রাশিয়া, জাপান, ভারতের মতো বড় মিত্র দেশগুলি রোহিঙ্গা ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তারা প্রকারান্তরে মিয়ানমারের চ- নীতিকেই সমর্থন করে যাচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুদিন আগে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন যে শীঘ্রই এই সমস্যার সমাধানে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশÑমিয়ানমার, চীনÑত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। মিয়ানমারের পক্ষে চীনের এই ধরণের কৌশলী কূটনীতি এবং জাতিসংঘে চীনের ভূমিকা ভাববার বিষয়। বাংলাদেশ চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে উচ্চাশা পোষণ করে। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী দেশ ভারত জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকার ব্যাপারটি বিস্ময়কর কেননা ভারত প্রতিবারই রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে আছে মর্মে বলে আসছে। বাংলাদেশ দুই দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায় কিন্তু ভারতের নিকট থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সুস্পষ্ট কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সার্কভুক্ত দেশ নেপালও শ্রীলঙ্কা ভোটদানে বিরত থেকেছে, এখানে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চেষ্টা চালিয়ে আসছে কিন্তু তাতে এশিয়ার বড় ছোট দেশগুলির সক্রিয় সমর্থন-প্রয়োজন হবে। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে ন্যায্যতা এবং মানবিকতার চাইতে ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ এবং ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রাধান্য পাচ্ছে। শুধু রোহিঙ্গা নয়, মিয়ানমার তার দেশের অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের নাগরিক ও আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। জাতিসংঘের কমিটিতে প্রস্তাব পাশ হলেও চীন, রাশিয়া নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদে এ বিষয়ে সক্রিয় কার্যক্রম গ্রহণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ভারতও নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হবে আগামীতে, এই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের কূটনীতি আরও জোরদার করতে হবে। বৃহৎ শক্তিগুলির সাথে যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ করতে হবে। সেই সাথে আন্তর্জাতিক নানা ফোরামে ও আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের বিষয় এবং তাদের প্রত্যাবাসনের বিষয় আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।
মতামত সম্পাদকীয়