রোহানের বাবা

আখতারুল ইসলাম »

রোহানের বাবা নেই। রোহান যখন ক্লাস টুতে পড়ে তখন তার বাবা মারা যায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা যায়। রোহানের বাবার কথা সব মনে আছে। বাবা রোহানকে খুব ভালোবাসতো। সে মায়ের সাথে নয় বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতো। বাবা ছিল রোহানের ছোট্ট পৃথিবীর বড় বন্ধু। অনেক সময় রোহান বাবাকে মা মা বলে ডাকতো। রোহানের বাবা বলতো, আমি তো তোমার বাবা। রোহান বলে, তুমি আমার বাবাও আবার মা-ও। রোহানের বাবা জিজ্ঞেস করত, কেনো?
রোহান বলে, তুমি আমাকে বেশি আদর করো তাই।
বাবা বলে, শোনো রোহান তোমার মা শুনলে কষ্ট পাবে। আমি বাবা, আর মাকে মা বলে ডাকবে।
রোহান বলে, ঠিক আছে বাবা।
রোহানের বাবা স্কুল শিক্ষক, সারাদিন পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এর ফাঁকে যেটুকু সময় পায় তা ছেলের সাথে নানান খুনসুটিতে লেগে থাকে। একদিন রোহানের মা রোহানকে বলে, রোহান তুমি বড় হয়ে কী হবে?
রোহান বলল, আমি বাবা হব।
রোহানের একথা শুনে বাবা মা দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। রোহান বাবা মায়ের হাসি দেখে খুব অপমান বোধ করে। বলে, তোমরা হাসছো কেনো?
মা বলে, না এমনি। তুমি বাবা হবে তো তাই?
রেহান বলে, তবে কী ?
বাবা বলে, তুমি বলবে বাবার মতো টিচার হবে।
ঠিক আছে বাবা, আমি তোমার মতো টিচার হবো।
একথা শুনে বাবা রোহানকে বুকে টেনে নেয়।
সেই প্রিয় বাবা, প্রিয় বন্ধু গত হয়েছে আজ অনেক দিন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য ও বাবাকে সে ভুলতে পারেনি। সবসময় বাবার কথা তার মনে পরে। বাবার যত স্মৃতি আছে তা আঁকড়ে থাকে দিনরাত।
একদিন রোহান তাদের দুতলা বিল্ডিংএর ছাদে যায়। ছাদে বাবার হাতে গড়া একটা ফুল ফলের বাগান আছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি রোহানের বাবার ছাদকৃষি ছিল খুবই পছন্দের।
বাবার মতো রোহান ও গাছগুলোর যত্ন নেয়। আজ হাতে একটা বেত নিয়ে গাছগুলোকে শিক্ষার্থী বানিয়ে নানান কথা জিজ্ঞেস করছে। বলে, দেখি তুমি পড়া বলো, পড়া না পাড়লে বকা দেয়। কেনো পড়া শিখনি জানতে চায়। বেত দেখিয়ে বলে, এই দেখেছো বেত, তাড়াতাড়ি পড়া শেখো না হয় বেত দেবো।
ঘরে মা রোহানকে না দেখে তাকে খুঁজতে আস্তে আস্তে ছাদে আসে। পেছন থেকে ছেলের এসব কাণ্ড দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারে না। বৃষ্টি ফোটার মতো অঝোরে চোখের পানি ঝরছে মায়ের দুচোখ বেয়ে বেয়ে। রোহান মাকে দেখে পেছনে বেত লুকিয়ে কী না কী করবে ভেবে পায় না। মায়ের কান্না দেখে রোহান ও হাঁউ মাঁউ করে কেঁদে ওঠে। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নেয়। ভাবতে থাকে রোহানের বাবার কথা, কত ভালো মানুষ ছিল। তার প্রভাব ছেলের প্রতিটি কাজ কর্মে। মা ও ছেলের কান্নায় একটা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
রোহান বলে, মা আমি এমন আর করবো না । আর এমন হবে না । সরি মা, প্লিজ মা কেঁদো না।
রোহানের মা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলে, না রোহান কিছুই হয়নি। আমার লক্ষ্মী ছেলে, বাসায় চলো। স্কুলের হোমওয়ার্ক আছে।
মা ছেলে বাসায় আসে। রোহান পড়তে বসে। স্কুলের পড়াগুলো তৈরি করছে। বাসায় বাবার অনেকগুলো ছবি। রোহান মাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা আর আসবে না?
মা বলে, আসবে যেদিন তুমি পড়ালেখা করে তোমার বাবার মতো অনেক বড় হবে। বাবার মতো ভালো ও আদর্শবান মানুষ হবে , তখন আসবে।
আচ্ছা মা, শিক্ষক হলে কি অনেক বই পড়তে হয়?
মা বলল, শুধু শিক্ষক কেনো, পড়ালেখা শিখে জ্ঞানী গুণী হতে গেলে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই ও পড়তে হয়। শোনো রোহান, তুমি শামসুর রাহমানের ‘ট্রেন’ ছড়াটি পড়, আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি।
রোহান পড়ে-
“ঝক ট্রেন চলেছে
রাত দুপুরে অই,
ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে
ট্রেনের বাড়ি কই?”
পড়তে পড়তে বাবার ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে রোহানের। মাথাটা ঘুরতে থাকে। হঠাৎ অন্য রকম অনুভূতি অনুভব করে। কার যেন ডাক শুনতে পায় রোহান। এই রোহান , এই রোহান। রোহান অবাক হয়। বাবা, বাবা তুমি।
বাবা বলল, হ্যাঁ আমি। তুমি পড়ছো?
জ্বি বাবা।
শোনো রোহান, ঠিকমতো পড়াশোনা করবে, মায়ের কথা শুনবে। নিয়মিত স্কুলে যাবে, বড়দের সম্মান করবে। সব সময় সত্য কথা বলবে। মানুষ ও দেশকে ভালোবাসবে।
রোহান বাবাকে দেখে অবাক হয়। বলে, আচ্ছা বাবা। বাবা তুমি কোথায় ছিলে? আর যাবে না তো ? কত দিন পর এলে।তুমি ছাড়া আমার একদম ভালো লাগে না। আমি তোমার সাথে ঘুরবো। মাঠে যাবো। বাগানে পানি দেব। স্কুলে যাবো।
বাবা রোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাবার আদর স্নেহে রোহানের চোখ বুজে আসে।
হঠাৎ ডাক দেয় মা, রোহান পড়ছো তো , আমি আসছি। বলতে বলতে ঘরে ঢুকে মা। দেখে রোহান এক দৃষ্টিতে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে আর বিরবির করে কী যেন বলছে। মা যে রুমে ঢুকেছে সেদিকে তার খেয়ালই নেই। মা, রোহান রোহান ডাকলেও তাতে রোহানের হুশ নেই। গায়ে হাত দিয়ে ডাকে এই রোহান , ঠিক কখনি রোহানের হুশ হয়।
রোহান বলে, মা বাবা কই? বাবা এসেছে । আমাকে আদর করেছে। অনেক কথা বলেছে।
মা বলে কই তোমার বাবা?
রোহান বলে, সত্যি মা বাবা এসেছিল।
মা ছবি দেখিয়ে বলে অই তো তোমার বাবা। রোহান তা মানতে চায় না , মা আদর করে বলে নাস্তা খাও রোহান।
নাস্তা দিয়ে মা ভাবে। ছেলের সারাক্ষণ বাবা বাবা। বাবার এই অভাব কীভাবে পূরণ করবে ভেবে পায় না। মা বলল, রোহান তুমি হয়তো বাবাকে বেশি ভেবেছ তো তাই স্বপ্নে দেখেছো।
রোহান বলে, না মা জেগে জেগে কেউ স্বপ্ন দেখে।
মা বলে, দেখে দেখে। এটা বলতে বলতে রোহানকে বুকে জড়িয়ে ধরে। মায়ের আদরে রোহান মুখ লুকালেও বাবার স্নেহের রেশ রয়ে যায় তার মাথায়।