হুমাইরা তাজরিন
নগরের বুকে ‘হাতির বাংলো’ নামে বাংলাদেশ রেলওয়ের নান্দনিক স্থাপত্যটি সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকলেও এর অবকাঠামো হয়ে পড়েছে জীর্নশীর্ণ।
শনিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, এই বাংলোর দরজা-জানলায় মরিচা পড়েছে। ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তরা। রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেলওয়ের একজন কর্মচারী সেখানে অবস্থান করলেও বাংলোর আশপাশ, ভিতর ও উপর তলায় র্দীঘদিনের ময়লা ও পাতা জমে আছে। পাতার সাথে বেলকনিতে জমে আছে বৃষ্টির পানি। জমা পানির কারণেই দেয়ালে সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষত এবং পরিশেষে খসে পড়ছে পলেস্তরা। সেই খসে পড়া পলেস্তরার অংশে উপর থেকে কক্ষে পড়ছে বৃষ্টির পানি।
১৯৯৬ সাল থেকে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের কর্মচারী জাকির হোসেন বাংলোটিতে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। তিনি জানান, প্রায় ৭-৮ বছর থেকে এখানে কোনো কর্মকর্তা থাকার জন্য আসেননা। তিনি একাই এখানে থাকেন। সামনের দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখা গেলো মাঝখানের কক্ষটাকে তিনি শোবারঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন। তার মতে, এটিই একমাত্র কক্ষ যেটি ঠিকঠাক আছে। সেটি পেরিয়ে অপর কক্ষটিকে তিনি রান্নাঘর হিসেবে ব্যবহার করছেন যেখানে রান্নার সরঞ্জামাদির দেখা মিললো। বাংলোর একেবারে পেছনের লেজাকৃতির অংশে রয়েছে গোসলখানা ও শৌচাগার। বাকি কক্ষগুলো প্রায় খালি পড়ে আছে।
সিআরবি এলাকায় হাতির আদলে নির্মিত বলে এর নামকরণ করা হয়েছে ‘হাতির বাংলো’। সবুজে ঘেরা এই বাংলোটি নগরের প্রাণকেন্দ্রে হলেও পাহাড়ের চূঁড়ায় হওয়ায় যানবাহনের শোরগোল কানেই আসেনা। সিআরবির সবুজের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে চূঁড়ায় উঠতেই চোখে পড়ে এই হাতির বাংলো। হাতির আকার হিসেবে বড়ো হলেও স্থাপত্য হিসেবে খুব বেশি বড়ো নয় বাংলোটি। ডুপ্লেক্স বাংলোটিতে নিচে ৪টি এবং উপরে ১টিসহ মোট ৫টি কক্ষ রয়েছে। হাতির বিরাট পেটের অংশের উপর ও নিচের ২টি কক্ষ তুলনামূলক বড়ো। এই কক্ষগুলো মূলত বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার হতো। এসব কক্ষের দুইপাশে ২টি করে ৪টি এবং সামনে পিছনে ২ টি করে মোট ৬টি জানালা রয়েছে। সংর্কীণ সিঁড়ি ভেঙে উপর তলায় উঠলে রয়েছে হাতির পিঠ আকৃতির কক্ষ। কক্ষের বাইরে রয়েছে মনোরম বেলকনি। এতে দেওয়া হয়েছে হাতির শুঁড়ের গড়ন। এই শুঁড়ের উপরে দুপাশে রয়েছে হাতির চোখ আকৃতির ছিদ্র। এই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সবুজ প্রকৃতি। বাংলোর পিছনের অংশে রয়েছে লেজ আকৃতির লম্বা বর্ধিত অংশ। হাতির গড়ন দিতে এই স্থাপত্য নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে ‘ফেরো সিমেন্ট’। এই সিমেন্ট একটি বিশেষ ধরণের সিমেন্ট যাতে কংক্রিট মিশ্রিত থাকে ,তারজালি ব্যবহার করা স্থাপনায় যার প্রয়োজন পড়ে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৌশলী ব্রাউনজারের অধীনে চট্টগ্রাম থেকে ফেনী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সেই লক্ষ্যে রেলওয়ে কর্মর্কতাদের বসবাসের জন্য উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত হয় এই ভবনটি। ৭ থেকে আট বছর আগেও এখানে বসবাস করার জন্য রেলওয়ে কর্মকর্তারা আসতেন। তবে বর্তমানে কোনো রেল কর্মকর্তা থাকার উদ্দেশ্যে এখানে আসেননা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চলের) চট্টগ্রামের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘ভবনটি বেশ বড়ো নয়। তাই এটিকে অন্যকিছুতে রূপান্তর না করে সংস্কার করে সেখানে পুনরায় বসবাসের ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ করা হবে। ’
বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলোটি দেখতে আসা দর্শনার্থীরা বলছেন, এইরকম নান্দনিক স্থাপত্য বাংলাদেশে খুবই কমই আছে তাই একেবারে নষ্ট হওয়ার আগে এখনই উদ্যোগ নিয়ে এটিকে রক্ষা করা সম্ভব।
বাংলো দেখতে এসে আরিফুল ইসলাম নামের এক দর্শনার্থী বলেন,‘বাংলোটা আমার খুব ভালো লাগে। নিরিবিলি হওয়ায় এখানে প্রায় ঘুরতে আসি। কিন্তু এটার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আগামী কয়েক বছরে আর এটি এমন থাকবেনা। অথচ এইরকম পুরোনো নান্দনিক স্থাপত্য বাংলাদেশে খুবই কমই আছে তাই একেবারে নষ্ট হওয়ার আগে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী হলে পর্যটন স্পট, জাদুঘর, লাইব্রেরি কিংবা পুনরায় বসার উপযোগী করে তুলে এটিকে রক্ষা করা সম্ভব।