রাসেলস ভাইপার নিয়ে উৎকণ্ঠিত না হয়ে সতর্ক হোন

স্বাধীনতার পরপর ব্যাঙ রপ্তানির হিড়িক পড়েছিল। মানুষ রাতদিন ব্যাঙ শিকার করতে করতে দেশকে ব্যাঙশূন্য করে ফেলেছিল প্রায়। এটা করতে গিয়ে সর্বনাশ হয়েছে ফসলের। ব্যাঙ না থাকায় পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। আর সে পোকা দমনে কীটনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে সমূহ ক্ষতি হয়েছে জমির। আর ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এরপর বেশ কয়েকবছর আগে শুরু হলো তক্ষক শিকার। পাহাড়ি জেলা ও উপজেলাগুলোতে অনেকদিন ধরেই সক্রিয় তক্ষক পাচারকারীরা। সেখানে বিভিন্ন এলাকায় তক্ষক পাচারকারীরা স্থানীয়দের কোটি টাকার লোভ দেখায়। তাদের বলা হয়, একেকটি তক্ষকের মূল্য কোটি টাকা। এভাবে দেশের বাইরে পাচার এবং পাচারকারীদের হাতে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় পাঁচ হাজারেরও বেশি তক্ষক হারিয়ে গেছে। অথচ বন্য প্রাণী আইন ২০১২ এর ৩২ ধারা মতে তক্ষকজাতীয় প্রাণী ধরা ও পাচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এখন শুরু হয়েছে রাসেলস ভাইপার নামে চন্দ্রবোড়া সাপ নিধনের নিষ্ঠুর খেলা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, মানুষ না বুঝেশুনেই সাপ মেরে ফেলছে। রাসেলস ভাইপার ভেবে অজগর সাপও মেরে ফেলছে। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে রাসেলস ভাইপার সাপ মেরে ফেলার প্রচারণাও চালানো হচ্ছে ফেসবুকে। এমন অবস্থায় ফরিদপুরের একজন রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন যে, রাসেলস ভাইপার সাপ মারতে পারলে প্রতিটির জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।
অনেকে বলছেন, রাসেলস ভাইপার খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে। ফলে সহসা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এই সাপের আধিক্য মানুষের জন্য হুমকি তৈরি করবে। আসলে, রাসেলস ভাইপার নিয়ে যে মাত্রায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে তা কতটা যৌক্তিক। সাপ গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ প্রজাতির সাপ কামড়ালে তারও চিকিৎসা আছে এবং সময়মত চিকিৎসা নিতে পারলে মৃত্যুঝুঁকি কমে আসে। বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে রাসেলস ভাইপার মোটেও দেশের সবচেয়ে বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী সাপ নয়। বরং দেশে প্রতি বছর সাপের কামড়ে যত লোক মারা যায় তার অর্ধেকই মারা যায় পাতি কেউটে সাপের কামড়ে। তবে সময়মত চিকিৎসা না নিলে রাসেলস ভাইপারের কামড়েও মৃত্যু হতে পারে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেছেন দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম (সাপ কামড়ালে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়) আছে এবং সব জায়গায় হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিষের বিরুদ্ধে কার্যকর বা বিষ নিষ্ক্রিয় করতে পারে এমন উপাদানকে অ্যান্টিভেনম বলা হয় ।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসেবে ২০২৩ সালে চার লাখ সাপের কামড়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাড়ে সাত হাজার মানুষ মারা গেছে যাদের বেশিরভাগই কোবরা ও কেউটে প্রজাতির সাপের কামড়ের শিকার হয়েছেন।
সাপের কামড়ে মনে রাখা উচিত- পায়ে দংশনে বসে যেতে হবে, হাঁটা যাবে না। হাতে দংশনে- হাত নড়াচড়া করা যাবে না। হাত পায়ের গিরা নড়াচড়ায় মাংসপেশীর সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে বিষক্রিয়া করতে পারে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে। ঘড়ি বা অলংকার বা তাবিজ, তাগা ইত্যাদি থাকলে খুলে ফেলুন। দংশিত স্থানে কাটবেন না, সুই ফোটাবেন না, কিংবা কোনো রকম প্রলেপ লাগাবেন না বা অন্য কিছু প্রয়োগ করা উচিত নয়। সাপে কাটলে ওঝার কাছে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যান। আতঙ্কিত হবেন না, রাসেল ভাইপারের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে পাওয়া যায়। কাজেই হুজুগের বশে কিছু না করে সঠিক তথ্য নিন। নিজেদের নিরাপদ রাখুন। পরিবেশও সুরক্ষা করুন।