শ্যামল রুদ্র, রামগড়
খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় উপজেলা পরিষদের মেরামত কাজের আওতায় সরকারি ভবনের সংস্কার কাজের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে প্রায় ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে নথিপত্রে সম্পন্ন দেখানো হলেও বাস্তবে এই প্রকল্পের কাজ আদৌ হয়েছে কি না, তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে ।
অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগের উপজেলা প্রকৌশলী মো.নাইমুল ইসলাম নিয়ম ভেঙে নিজেই প্রকল্পের বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রকল্পে ঠিকাদারের নাম থাকলেও তিনি ছিলেন শুধুমাত্র কাগজে। বাস্তবে কাজ পরিচালনা করেছেন ওই প্রকৌশলী নিজেই, অবশ্য সঙ্গে রেখেছিলেন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো.নাইমুজ্জামান কবীরকে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ‘রিকোয়েস্ট ফর কোটেশন’ ((RFQ) পদ্ধতিতে উপজেলা প্রশাসন ভবন-১ ও ২, ‘বাতায়ন’ ভবন, তৃতীয় শ্রেণির ডরমিটরি ও ফ্যামেলি কোয়ার্টারসহ একাধিক সরকারি স্থাপনার সংস্কার কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, স্থানীয় ভাবে একজন মিস্ত্রির মাধ্যমে কয়েকটি লাইসেন্স সংগ্রহ করে ঠিকাদার দেখানো হলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল প্রকৌশল কর্মকর্তার হাতে। ফলে সরকারি বিধিমালার সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটে।
জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী নাইমুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা পরিষদের মেরামত কাজটি মূলত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থে বাস্তবায়িত হয়েছে, যা ইউএনও মহোদয়ের প্রচেষ্টায় হয়েছে। আমি উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে কেবলমাত্র কারিগরি সহায়তা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেছি। সার্বিক পরিকল্পনা, বাজেট প্রাপ্তি ও বাস্তবায়নে ইউএনও মহোদয়ই মুখ্য ভূমিকা পালন করছেন।’
সরেজমিন দেখা গেছে, অধিকাংশ ভবনে কোনো ধরনের মেরামতের বলিষ্ঠ চিহ্ন নেই। কোথাও কোথাও কেবল দেয়ালে হালকা রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির ডরমিটরির দেয়াল ভাঙা, ছাদে চুইয়ে পানি পড়ছে, ফ্যামেলি ও ব্যাচেলর কোয়ার্টারের অবস্থাও অবনত। ‘বাতায়ন’ নামের ভবনের অবস্থাও তদ্রূপ। দেয়ালে বড় ফাটল, জানালার লোহার গ্রিল নড়বড়ে, ছাদে জমে থাকা পানির দাগ স্পষ্ট—কিন্তু নথিতে দেখানো হয়েছে, ভবনটির সংস্কার সম্পন্ন।
‘বাতায়ন’ ভবনের বাসিন্দা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বারবার অনুরোধ করেও কাজ করাতে পারিনি। দায়সারাভাবে ছিটেফোঁটা কিছু কাজ করে বিষয়টি গা-ছাড়াভাবে শেষ করে দেওয়া হয়েছে।’
অথচ এসব ভবনের জন্য বরাদ্দ অর্থ বিল হিসেবে উত্তোলন করা হয়েছে পুরোটাই। হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়ের ভবনও সংস্কার তালিকায় ছিল। কিন্তু বর্ষা আসলেই সেই অফিসে পানি ঢোকে। প্রকল্পের নামে বিল ওঠানোর পরও কোনো দৃশ্যমান কাজ না থাকায় ক্ষোভ জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পানি ঢুকে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইলপত্র ভিজে গেছে। আমরা সত্যিই বড় ধরনের বিপাকে পড়েছি। গত দুই-এক মাসে এখানে কোনো ধরনের সংস্কার কাজও হয়নি।’
এ প্রসঙ্গে হিসাব রক্ষণ অফিসের অডিটর খোন্দকার কবিরুল হাসান বলেন, সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করেছি কাজ করতে। কিন্তু করেনি তাই বিল আটকে রেখেছিলাম। চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত বিল অনুমোদন করতে হয়েছে।
হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ের কর্মচারী বিবি হালিমা বলেন, ছাদ চুইয়ে পানি ঢুকে ফাইলপত্র ভিজে যায়। এমনকি ফ্লোরে জমে থাকা পানিতে বসে কাজ করতে গিয়ে পায়ে ঘা হয়ে গেছে, জ্বরও উঠেছে।”
একজন প্রবীণ বাসিন্দা বলেন, ‘আমরা নিজের চোখে দেখছি, তেমন কাজ হয়নি। অথচ কাগজে প্রায় ৪০ লাখ টাকার হিসাব দেখানো হচ্ছে। এভাবে যদি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের অধিকার কোথায় থাকবে?’
উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মো. শাহআলম মজুমদার বলেন, ‘যা শুনেছি, তাতে মনে হচ্ছে এটি আর পুকুর চুরি নয়, যেন সরাসরি ডাকাতি! আমরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।’
তৃতীয় শ্রেণির ডরমিটরির বাসিন্দা সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শামীম আহমেদ বলেন, ‘আসলে কাজ বলার মতো কিছুই হয়নি। নামমাত্র কিছু দেখিয়ে পুরো টাকাই মেরে দিয়েছে।’
বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, উপজেলা প্রশাসনের অন্তত দু’জন কর্মকর্তা তাদের ব্যবহারের জন্য ভবনের কিছু অংশ নিজ উদ্যোগে সংস্কার করেন এবং পরে সেই ব্যয় সরকারি প্রকল্পের আওতায় সমন্বয় করা হয়।
জানতে চাইলে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজী শামীম বলেন, ‘উল্লেখিত কাজগুলো আমার রামগড়ে যোগদানের আগেই সম্পন্ন হয়েছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকৌশল বিভাগের নিকট থেকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র পর্যালোচনা করেছি। সুষ্ঠুভাবে কাজ হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রকৌশলী। তবে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে চাইলে সবাই মিলে সরেজমিনে গিয়ে কাজের প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে পারি।’