রাতফেরার : অবশেষে জেনারেল

প্রথম বই

অভীক ওসমান »

গত শতাব্দীর আশির দশকে রাজনীতি ব্যান্ড হয়ে গেলে সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্যামোফ্লেজে আমরা কালচারাল এ্যাক্টিভিটিজ শুরু করলাম। চট্টগ্রাম কলেজে ‘বির্বতন’ নামে সংগঠনের ব্যানারে আমার প্রথম নাটক ‘তিরোহিত সুন্দর আমার’ মঞ্চস্থ হলো (৭ জুন ১৯৭৬)। ২৮ জুলাই করলো আসরকার দীঘিস্থ ‘পূরবী ললিত কলা একাডেমি’। পরে ১৯৭৮ লিখলাম গণায়ন’র জন্য রাত ফেরার, এটি গণায়ন ম্যাগাজিনে প্রকাশ হওয়ার পর গাইবান্ধা, কক্সবাজারসহ পুরো বাংলাদেশে মঞ্চস্থ হয়। এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় “অবশেষে জেনারেল” (১৯৮৬) লিখলাম।
পদ্যই বেশী লিখতাম। কিন্তু নাটক দুটো পপুলার হয়ে গেল। তাই ‘রাত ফেরার’, ‘অবশেষে জেনারেল’ নিয়ে বের হয়ে গেল আমার প্রথম বই। প্রচ্ছদ করলেন উত্তম সেন। স্বাধীনতার পর থেকে আমি ৪৯ ঘাটফরহাদবেগে থাকতাম। উত্তম থকতো কিছুটা ভিতরে চর্যাপদের টিলার মতো একটা ঘরে। প্রয়াত কবি প্রণয় মজুমদারও থাকতো। তখন কম্পিউটার আসেনি। মুদ্রণ করেছে ফিরিঙ্গী বাজারের প্রয়াত ক্রীড়াবিদ আবু তাহের পুতুদের বাসার কাছের সুরমা প্রিন্টার্স। উত্তম সেন কোন পয়সা কড়ি চায়নি। আমি তখন চেম্বারের ডেপুটি সেক্রেটারি। বই বের হওয়ার অনেক পরে বাদামতলীস্থ চেম্বার হাউজের মেজানাইন ফ্লোরে আমার রুমে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল ওসমান ভাই। কিছু মুদ্রা দেয়া গেছিলো। বোঝা যাচ্ছে তখন আর্টিস্টরা অত ডিমান্ডিং ছিল না।
১৯৭৮ এ আমাকে গণায়নের সতীর্থরা নাটক লিখতে বললেন। এ প্রেক্ষাপটে রচিত হলো ‘রাত ফেরার’। আমার মনে পড়ছে খসড়া পাণ্ডুলিপিটি দ্রুত নাট্যরূপ দেওয়ার জন্য আমি, প্রণব দাশ একরাতে আশ্রয় নিই ও আর. নিজাম রোডের তৎকালীন চিত্র নায়িকা কবিতার স্বামী, এককালীন ভাসানীপন্থি রাজনৈতিক নেতা বাংলাদেশের বিখ্যাত ধনকুবের গোলাম কবিরের বাসায়। গোলাম কবিরের ভাগ্নে সাংস্কৃতিক জোট নেতা গোলাম কুদ্দুস (তখন বৈজ্ঞানিকপন্থি চট্টগ্রাম সিটি ছাত্রলীগের সাহিত্য সম্পাদক) এবং তার অনুজ মুকুল চট্টগ্রাম কলেজে আমাদের সহকর্মী। সেই সুবাদে ঐ বাসায় যাওয়া। তখন ও. আর. নিজাম রোড রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় তথা চট্টগ্রামে এ ধরনের রাজসিক বাড়ি গড়ে ওঠেনি। ফজরের আজানতক জেগে সারারাত ধরে আমি আর প্রণব পাণ্ডুলিপিটি ঠিক করি। মনে পড়ছে মধ্যরাতে ‘রাত ফেরার’ এর ঢাকায় সূর্যসেন হলে আমাদের আর্টিজান সজল সেন ভুট্টো চিৎকার করে সংলাপ বলছে- “সুনসান রাত। সাপের খোলসের মতো পড়ে আছে পথ, অসুস্থতার চাদরে মুমূর্ষু রাজপথ। তার ওপর দর্পিত পদভারে ছুটছে মাতাল ঘোড়া তড়াক তড়াক তড়াক। চাবুক পড়ছে পিঠে সপাং সপাং, তীক্ষ্ম ক্ষুরের আঘাতে ভাঙছে জানালার মসৃণ কাচ, দালান, মানুষের ভালোবাসার বসতি। এই অস্থির তাড়নায় আমরা ছুটছি- ছুটব- এ পথে ও পথে, এ ঘরে ও ঘরে।”
‘রাত ফেরার’ সম্ভবত সেন্ট স্কলার্সটিকাস স্কুল অডিটোরিয়ামে প্রথম মঞ্চস্থ হয়। এর সাথে আমাদের পুরনো নাটক ‘গফুর- আমিনা সংবাদ’ও অভিনীত হয়। প্রথম রজনিতে অভিনয় করেন শিশির সেন, প্রণব দাশ, গায়ত্রী সেন, দেওয়ান মামুন, সজল সেন ভুট্টো, অধ্যাপক মশিউর রহমান আদনান। পরবর্তীতে খ্যাতনামা ফটোগ্রাফার প্রয়াত মৃণাল সরকার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। মনে পড়ছে মুসলিম হলের একটি শো’র বিষয়ে সিনেপত্রিকা চিত্রালী স্টাইলে লেখা নাটকের টাইটেল দিয়ে দৈনিক মিছিলে শামসুল হক হায়দারী কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
এ প্রসঙ্গে গ্রন্থাকরে যখন ‘রাত ফেরার’ প্রকাশিত হয় তখন গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী ‘পূর্বলেখ’ত বলছেন, “‘রাত ফেরার’ সম্পর্কে দুটো ঘটনার উল্লেখ করতে হয়। আশির দশকের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়কে নাট্যকার সরাসরি পর্যবেক্ষণ করেছেন। চট্টগ্রাম শহরের লয়েল রোডের দোকানসারি, নিচে দোকান, ওপরে বাস- এ ধরনের ঘরে বিনিদ্র রাত্রির অভিজ্ঞতা ‘রাত ফেরার’। নিদ্রা আর জাগরণ, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন, শহর আর গ্রামের ‘মন্তাজ কম্পাইলেশন’ রাত ফেরার। দ্বিতীয় তথ্যটি হচ্ছে- স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের জন্য যে নবীন প্রজন্ম আশায় বসতি বেঁধেছিল সেই প্রজন্মের একজন- আবু তাহের খান খসরু। হাজি ক্যাম্পের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অকথ্য নাৎসি অত্যাচারে তাকে হত্যা করা হয়। ‘রাত ফেরার’ এর তরুণ চরিত্র তার কিছুটা ছায়ায় নির্মিত তৎকালীন জেলা প্রশাসন ‘রাত ফেরার’ এর প্রথম দৃশ্য সেন্সর করেছিল।”
‘রাত ফেরার’ বাংলাদেশ রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ, স্বৈরশাসন, বহুবার সংগঠিত মিনি কু, মেধাবিক্রি, আর বেপরোয়া তারুণ্যের সংগ্রামের চালচিত্র। আমাদের সমাজ থেকে দুঃশাসনের রাত চিরতরে ফেরার হতে যাচ্ছে, আমাদের সুখ- সাম্যের সোনালি সকাল আসছে- এটাই ‘রাত ফেরার’- এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
দেশখ্যাত নাট্যকার মামুনুর রশিদ শিল্পকলা একাডেমিতে ‘রাত ফেরার’ দেখতে দেখতে বলেন, ওসমানের অন্যান্য নাটকের মতো ‘রাত ফেরার’ও কাব্যক্রান্ত ‘রাত ফেরার’ নাটকটি গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের একটি সফল ও উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ২০০১ সালে গণায়নের রজতজয়ন্তী উপলক্ষ্যে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। কবি অধ্যাপক, চিন্তক মাহফুজ পারভেজ বলেন, ‘নীল দর্পণের’ পর বাংলা সাহিত্যের এই দ্বিতীয় নাটক যেটি সেন্সর করা হয় তা হচ্ছে অভীক ওসমানের ‘রাত ফেরার’ (সূত্র : দৈনিক পূর্বকোণ, ফেব্রুয়ারি ২০০১)।
১৯৮৬ তে গণায়ন আমাকে দিয়ে প্রায় জোর করেই লিখিয়ে নেয় পথনাটক ‘অবশেষে জেনারেল’। দেব পাহাড়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অফিসে এর রিহার্সাল হতো- কিছুটা নির্দেশনা আমি নিজেও দিয়েছিলাম।
পূর্বলেখ থেকে পুনর্বার উদ্ধৃত করছি- “একটি অনির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যানে জানা যায়, পৃথিবীর কমবেশ ৬৪টি দেশে এখন মার্শালম্যানরদের শাসন চলছে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো হচ্ছে মার্শাল ও তার মনিব সাম্রাজ্যবাদীদের স্বস্তিময় চারণক্ষেত্র। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, বাংলাদেশের স্বাধীনোত্তর পর্যায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সময় কেটে যাচ্ছে স্বৈরশাসনের মাধ্যমে। ‘অবশেষে জেনারেল’ সেই ট্র্যাডিশনাল জেনারেল নাটক।
গণায়ন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম পথনাটক করে। সেই ঐতিহ্যের পথ ধরে ঢাকায় কারফিউ ভেঙে প্রথম জাতীয় পথনাট্য উৎসবে ‘অবশেষে জেনারেল’ প্রদর্শিত হয়। শহরের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য জায়গায়, জনসভায়, শহিদ মিনারে ‘অবশেষে জেনারেল’ প্রদর্শিত হয়েছে। এই নাটক দেখে স্বতঃস্ফূর্ত জনতা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেছে, মধ্য নিশীথে হাজার হাজার শ্রমিক উন্মুক্ত মঞ্চের পাদপ্রদীপে এই নাটক উপভোগ করেছে; এখানেই আমাদের সার্থকতা। আমিন জুট মিলে প্রায় দশহাজার শ্রমিক পরিবেষ্টিত ‘যাত্রা মঞ্চের’ মতো মঞ্চে ‘অবশেষে জেনারেল’ দর্শক হিসেবে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, ঢাকা ‘স্বপ্ন ও সংগ্রাম’ (২০০৪) শীর্ষক সংকলন প্রকাশ করেছে। বাংলদেশ পথ নাটক পরিষদও এটা রিপ্রিন্ট করে।