আরিফুল হাসান »
[বলুন আল্লাহ, আপনিই সার্বভৌম। যাকে ইচ্ছা রাজ্যদান করেন, যার কাছ থেকে ইচ্ছা ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন। আপনার কাছেই সমস্ত কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান। আপনি রাতকে দিনের ভেতরে প্রবেশ করান এবং দিনকে রাতের ভেতর। জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আনেন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে। আর আপনিই যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিজিক দান করেন : কুরআনুল ক্বরীম ৩:২৬-২৭]।
রাত নিঝুম। জঙ্গলগড়ের রাজ্যে এখন লাশের স্তূপ। উত্তরদিকে দুয়েকটি ঘরবাড়ি ঝড়ে ওড়া শনপাতার মতো কাঁপছে। বিরান শূন্যতা দক্ষিণ প্রান্তরে। হাহাকারের মতো বাতাস এসে থাবড়ে পড়ছে ঘরদুটোর নাকেমুখে। ঘরের ভেতর তখন কাঁদার মতো কেউ নেই। যারা জয় করার, তারা লাশের স্তূপের ভেতর তাদের পতাকা লাগিয়ে চলে গেছে রাজধানীর দিকে আর যারা বিজিত হয়েছে, তাদের সবার ছিন্নমস্তক এখন প্রান্তরটিতে লুটোপুটি খেলছে। ধূসর চাঁদের ম্লান চোখে লাশের কান্না। বিরামহীন হাহাকার বাতাস, আর নেকড়ের হাসি ছাড়া আর কিছু নেই। সব কিছু শান্ত-চুপচাপ-গম্ভীর। এমন সময় দুটো ঘরের একটি ঘরে তুষের ডুলির মধ্যে অচেতন পড়ে থাকা বুড়ো মকবুলের জ্ঞান ফেরে। তখনও যুদ্ধ লাগেনি। দুপক্ষের সৈন্যরাও দূরে দূরে ছিল। তবু মকবুলের কানে এসেছে গ্রাম ছেড়ে লোকেদের চলে যাওয়ার শব্দ। যেহেতু যুদ্ধ ময়দান এখান থেকে মাইল দেড়েকের মধ্যেই আর এই বিরান শূন্যতা অতিক্রম করে শুধুমাত্র তাদের গ্রামটিই প্রথম, তাই এমন মৃত্যু-মৃত্যু উৎসবে মানুষজন পালিয়ে যাবে এমনটিই তো ভাবার ছিল। বুড়ো মকবুল আশায় ছিল কেউ না কেউ তাকে নিয়ে যাবে। কেউ হয়তো ডেকেছিলও, কিন্তু তুষের ডুলির মধ্যে অচেতন পড়ে থাকার কারণে সে ডাক হয়তো সে শুনতে পায়নি। হয়তো গ্রামের মানুষেরা মনে করেছে বুড়োকে কেউ না কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে এবং দূর রিফুজি ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু বুড়োকে কেউ নেয়নি। সকালে যখন সর্বশেষ দলটি গ্রাম ছাড়লো এমনকি তার প্রতিবেশীরাও যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছে, তখনও বুড়ো আশায় ছিল কেউ তাকে ডেকে নেবে, কেউ তাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবে দূর গন্তব্যের নিরাপত্তায় কিন্তু তখনই ঘটল বিপত্তিটা। একটা নিঃশব্দ কাশির ধমক আসলেও সে শব্দ করে কাশতে পারে না কেনো এই ভেবে তার চিকনঘাম ছুটে যায়। ঘামতে-ঘামতে অচেতন হয়ে মাচার উত্তরে লাগোয়া তুষের ডুলির মধ্যে পড়ে যায়। কবেকার পুরনো তুষে-কীটে তার দম বন্ধ হয়ে আসলে এই বিশ ঘণ্টা যখন অতিক্রম হয়েছে, তার জ্ঞান ফিরেছে, ততক্ষণে যুদ্ধে পূর্বেকার রাজা পরাজয় বরণ করেছেন। বুড়ো ডুলি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে। নাক-মুখ থেকে তুষ ঝেড়ে ফেলে শীর্ণ হাতে। কিন্তু তার নিঃসাড় দুটি পা বারবার ব্যার্থ হয় ডুলি থেকে মাচানে উঠতে। তবু সে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কোমর-সমান উঁচু ডুলির কান্দায় হাত রেখে মাচানের ওপর বুড়ো সর্বশক্তি দিয়ে দাঁড়িয়ে দক্ষিণের খোলা জানালায় দৃষ্টিকে ছেড়ে দেয় আদিগন্ত। তার চোখের সামনে বিস্তৃত প্রান্তর লাশে-লাশে সয়লাব চিত্রধারণ করে। বয়েস হলেও দেহের অপরাপর ভাটায় টানলেও মকবুল বুড়োর চোখ দুটো আজও তীক্ষè। মাইল দেড়েক দূরে বিচ্ছিন্ন-ছিন্ন মস্তকগুলো সে আন্দাজ করতে পারে। টুকরো-কাটা ধড়গুলো অনুমান করতে পারে। কালো ছায়ার মতো লাশের পাহাড়, আর চূড়ার মতো স্তূপে বিজয়ীপক্ষের পতাকা কত বক্ষ ভেদ করে পতপত উড়ছে জ্যোৎস্নায়, বুড়ো তা ধারণা করতে পারে। এমন সময় বুড়োর চোখে একটি সন্দেহ দেখা দেয়। তার মনে হয় লাশের স্তূপটি যেন নড়ছে। এতদূর থেকে নড়নচড়ন হয়তো দেখা যাবে না কিন্তু রাত এখন, বিভ্রমে-বিভ্রমে ভয়ানক রক্তচক্ষুর বিপরীতে বুড়োর ধীর-তীক্ষè দৃষ্টি যেন মাঝখানের মাইল-দেড় মাইলের শূন্যতা টেনেছিঁড়ে জুম করে কাছে নিয়ে আসে। নিথর রাতের মতো প্রকৃতিতে শেয়ালের আনাগোনা ভেবে বুড়ো দৃষ্টি সরাতে চায়, কিন্তু না, তার দৃষ্টি লেপ্টে থাকে লাশের স্তূপে পতাকাটার ওপর। কেউ যেন খুলে ফেলতে চাইছে পতাকাটা। এবার সত্যিই তাই মনে হয়, বিভ্রম নয়। বুড়ো সামর্থ্য থাকলে হয়তো সামনে যেত এগিয়ে অথবা আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত। কিন্তু তার সব কূলহারা বার্ধক্য আর বোধহীন পা দুটো ততক্ষণে অসাড় হয়ে আসলে বুড়ো আবারও বসে পড়ে ডুলির অন্ধকারে। কিন্তু তার কৌতুহলী দৃষ্টি তাকে বসে থাকতে দেয় না। সে আবারও অনেক কসরত করে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, কেউ সত্যিই পতাকাটা খুলে ফেলেছে। তখন আর তার কাছে এটি শেয়াল-নেকড়ের নড়াচড়া মনে হয় না এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে সে দেখতে পায় লাশের স্তূপের ভেতর থেকে একটি অবয়ব জেগে উঠেছে এবং পদতলে সহস্র লাশকে সাবধানে এড়িয়ে উত্তরদিকে এগিয়ে আসছে। বুড়ো বলছিলÑ আমার তখন ভয় করছিল খুব, আমি দেখছিলাম আমাদের সাবেক রাজাসদৃশ্য একজন লোক নেমে আসছে লাশের স্তূপ থেকে এবং প্রান্তর পেরিয়ে বিদ্যুৎবেগে দেড় মাইলের দূরত্বটা দ্রুতই কমিয়ে আনছে। আমি একই সাথে আশাবাদী এবং ভীতও হলাম। কারণ যুদ্ধে কোনো রাজার পরাজয় মানেই হয়তো সে বন্দি হয়েছে অথবা মৃত্যুবরণ করেছে। আমার আশংকাকে সত্যি করে তখন শেষরাতের ঘণ্টাদেড়েক আগে সত্যিই রাজা এসে আমার জানালায় উঁকি দেন এবং আমাকে ডুলির ভেতর থেকে উদ্ধার করেন। তখন রাজা আমাকে একটি গল্প বলেন : আসলে আমি তোমাদের রাজা ছিলাম না। তোমরা তো জানো, আমার আগের রাজা মারা যাওয়ার পর তোমরা ঘোর রাজাহীনতায় ভুগলে অতঃপর সর্বসম্মতিক্রমে মৃত রাজার হাতিটিকে ছেড়ে দেওয়া হল। সেই হাতি দুনিয়া খুঁজে যাকে তার পিঠে তুলে নেবে সেই হবে নতুন রাজা। তোমাদের পাঠানো হাতি কোন্ খেয়ালে আমাকে পিঠে চড়িয়ে নিল, আর আমি হয়ে গেলাম তোমাদের রাজা। আমি আসলে রাজা হতে চাইনি, রাখালই থাকতে চেয়েছিলাম। এই জরি-জহরত মাণিক্য পোশাক খুললাম, ধূলার মধ্যে ফেলে দিলাম। আজ থেকে আমি আবার রাখাল। কিন্তু তোমাদের রাজা হিসেবে সুখ তো অবশ্যই আমি ভোগ করেছিলাম আর তা সম্ভব হয়েছিল তোমাদের হাতিটি আমাকে পিঠে চড়িয়ে নেবার কারণে। আজ তার শোধ দেবো আমি। বুড়ো মকবুল বলে, অতঃপর রাজা আমাকে তার পিঠে চড়িয়ে নিলেন। ধূসর চাঁদের আলো অতিক্রম করে আরও মাইলপাঁচেক দূরে সীমান্তের ওপারে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে নিয়ে গেলেন। পথজুড়ে ধূ-ধু শূন্যতা। গ্রামগুলো, পাড়া-মহল্লাগুলো উজাড়। মানুষ তো দূরের কথা, পোষা কুকুর-বিড়ালও চোখে পড়ল না। মেঘগতিতে ছুটতে-ছুটতে সুবহি কাজেবের সময়, ঠিক যখন হঠাৎ অন্ধকারে সমস্ত দৃষ্টি নিভে যায়, তখন রাজা আমাকে গোপনে এখানে রেখে আবার দ্রুতগতিতে পালিয়ে যান। যাবার সময় আমি রাজার পদচুম্বন করে কেঁদে ফেলি। তারপর তিনি নিঃশব্দ কাজেবের অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে যান হঠাৎ। রিফুজি ক্যাম্পে বুড়ো মকবুলের গল্প শুনে দেশছাড়া হয়েও কেউ-কেউ ফিকফিক করে হেসে ফেলে। দুপুরের দিকে যুদ্ধ লেগে দুপুর না গড়াতেই যে রাজা পরাজয় বরণ করেন, যার সব সৈন্য কচুকাটা হয়, সেই তিনি নাকি আবার সারাদিন লাশের স্তূপের ভেতর জীবিত থেকে মধ্যরাতে উঠে এসে বুড়োকে রিফুজি ক্যাম্পে দিয়ে গেছেন! কিন্তু অসাড় পায়ের মকবুল এই ক্যাম্পে আসল কীভাবে তা নিয়েও অনেকের মনে সন্দেহ জাগে। কিন্তু তারা কিছুতেই বিশ্বাস করে না যে রাজা তাকে দিয়ে গেছেন। তখন বুড়ো মকবুল তার কোঁচড় থেকে রাজার অঙ্গুরীটি বের করে দেখান। বলেন, রাজা তাকে শেষচিহ্ন হিসেবে দিয়ে গেছেন এটা। উপস্থিত দেশহারাদের কারো-কারো দৃষ্টি থ মেরে যায়, দলিল-দস্তাবেজে হয়তো তারা এ অঙ্গুরীর নকশা অনুযায়ী মোহরাংকিত হতে দেখে থাকবে।