মোহীত উল আলম »
দেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতায় তাঁর ‘৭২ সালের জনসভার ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে পরপার থেকে এসে দেখে যেতে বলেছিলেন যে বাঙালী আর বাঙালী নয়, মানুষ হয়েছে: ‘কবিগুরু, আপনি বলেছিলেন “সাত কোটি বাঙালীরে হে মুগ্ধ জননী / রেখেছো বাঙালী করে, মানুষ করোনি,” কিন্তু আজকে আপনি এসে দেখে যান, বাঙালী মানুষও হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর এই কথার তাড়না ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বিষয়টি, যেখানে লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক দেশটি পৃথিবীর বুকে জায়গা করে নিয়েছিলো।
তাই, এ প্রশ্নটা এখন মনে জাগছে, রবীন্দ্রনাথ যদি এসময়ে বেঁচে থাকতেন, এবং থাকতেন বাংলাদেশে তা’হলে কী না খুশি হতেন তিনি। তাঁর প্রিয় বাংলাভাষার ওপর সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা দেশ–এ অনুভূতি কি তাঁকে আপ্লুত করতো না? তাঁরই গান তাঁর নিজের দেশ ভারত ছাড়া আরো একটি দেশের জাতীয় সংগীত–এবং তাও বাংলায়, এ অনুভূতি কি তাঁকে আনন্দ দিতো না? তাঁর সাহিত্যের অপূর্ব অংশ–তাঁর ছোটগল্পগুলো, যেগুলিতে গ্রামীন পটভূমি আছে–সবগুলি প্রায় পদ্মাপাড়ের কৃষক পরিবার নিয়ে লেখা, লিখতেন–যখন তিনি পদ্মাবোটে করে জমিদারী পরিভ্রমণে বের হতেন। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ আজকে বেঁচে থাকলে তিনি হতেন সবচেয়ে বেশি দ্বিখন্ডিত বাঙালী। হয়তো থাকতেন ভারতের নাগরিক হয়ে কিন্তু প্রাণ থাকতো তাঁর বাংলাদেশে: “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” অর্থাৎ, যদিও রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ বলতে পুরো ভারতবর্ষকে বুঝতেন, কেবল বঙ্গদেশকে বুঝতেন না, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে স্বদেশ বলতে শুধু বাংলাদেশকে বোঝার অবকাশ ছিল।
তবে আমরা যেমন জাতিগত পরিচয় দিতে জাতীয় সত্তা এবং দেশীয় পরিচয়কে গুলিয়ে ফেলি, বা বাঙালী আর বাংলাদেশীর মধ্যে প্রভেদ বুঝি না, রবীন্দ্রনাথের তেমন ছিল না। তিনি জাতীয় সত্তা বাঙালীত্বে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু যখন দেশীয় পরিচয়বলে নিজেকে ভারতীয় বলে গণ্য করতেন, তখনও মনে করতেন না যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ দিয়ে আন্দোলন করে ইংরেজ বিতাড়ণের কাজটি করা যাবে। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ নিয়ে ভাবনায় জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোন চিন্তা ছিল না। গান্ধীর সঙ্গে যে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক মতের অমিল ছিল সেটা এ স্বাদেশিকতা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নতি হলে সমাজের উন্নতি হবে, এবং সে ধাক্কায় ইংরেজ ভারতবর্ষ থেকে আপনাআপনি বিতাড়িত হবে। গান্ধী অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যত বড় কবি ছিলেন, ততটা বড়ই রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন। তাই তিনি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভাবনা আর গান্ধীর স্বদেশ ভাবনা এক ছিল না বলেই স্বদেশী আন্দোলন শুরু করার প্রাক্কালে গান্ধী রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছিলেন তাঁর সমর্থন আদায় করার জন্য। তাঁরা কথা বলছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। এসময় চিৎপুর রোডে হট্টগোল শুনে দু’জনেই বের হয়ে আসেন। স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থনে কিছু বিক্ষুব্ধ লোক একটি মারোয়ারীর কাপড়ের দোকান পুড়িয়ে দিচ্ছিলো, কেন না দোকানী বিলাতী বস্ত্র ডাই করেছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন ঘটনাটির দিকে গান্ধীর মনোযোগ আকর্ষণ করে বললেন যে স্বদেশী আন্দোলনের ফলাফল হচ্ছে বিলাতি বস্ত্র বর্জনের নামে ভারতীয়দের দোকানে ভারতীয়দের দ্বারা অগ্নিসংযোগ করানো। রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যা ছিল বিলাতি বস্ত্র যে আমদানী করেছে সে তো ভারতীয় ব্যবসায়ী, অর্থাৎ স্বদেশী, তার ক্ষতি হবে কেন? এসময়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতন, বোলপুর এবং সুরুলে তাঁর কৃষি বিপ্লব নিয়ে ব্যস্ত, এবং হয়তো ভেবেছিলেন যে গ্রাম-উন্নয়ন স্বদেশী আন্দোলনের চেয়ে শক্তিশালী হবে। গান্ধী অনেকটা ব্যর্থমনোরথ হয়ে কলকাতা থেকে ফেরত যান। যাবার আগে রবীন্দ্রনাথকে আরেকটি অনুরোধ তিনি করেছিলেন যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ পাশ বাবুদের হাতে চড়কা ধরিয়ে দিতে পারেন কিনা! রবীন্দ্রনাথ তাতেও সায় দেন নি। বলেছিলেন যে তাঁর কাজ কবিতা লিখে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করা, ছেলেদের হাতে চড়কা ধরিয়ে দেওয়া নয়।
গান্ধী ভারতের স্বাধীনতা দেখে যেতে পারলেও রবীন্দ্রনাথ পারেন নি। তাই সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের জন্য এখন ভারত যেমন একটি স্বাধীন দেশ বিবেচিত হবে, তেমনি বাংলাদেশও। তখন তাঁর পক্ষে বুঝতে সুবিধা হবে বাঙালী কি এখনও বাঙালী রয়ে গেছে নাকি মানুষ হয়েছে।
স্বাধীনতার তেপ্পান্ন বছর পর, এবং রবীন্দ্রনাথের ১৮৩ বছর উদযাপনের মাহেন্দ্রক্ষণে এ প্রশ্নটা আবারও উঠে আসা সংগত যে বাংলাদেশী বাঙ্গালী মানুষ হয়েছে কী না। এ প্রশ্নটার উত্তর আমরা রবীন্দ্রনাথের কিছু রচনা পাঠের মাধ্যমে খুঁজতে চাই।
তাঁর “নূতন ও পুরাতন” শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে ভারতীয় সভ্যতা হলো “বড়ো প্রাচীন, বড়ো শ্রান্ত।” কিন্তু এ জড় স্বভাবতো চলবে না। কারণ, “তুমি যখন বিশ্রাম করতে চাও, পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যে তখন অশ্রান্ত। গৃহস্থ যখন নিদ্রায় কাতর, গৃহছাড়ারা যে তখন নানা ভাবে পথে পথে বিচরণ করছে। তা ছাড়া এটা স্মরণ রাখা কর্তব্য, পৃথিবীতে যেখানে এসে তুমি থামবে সেইখান হতে তোমার ধ্বংস আরম্ভ হবে। কারণ, তুমিই একলা থেমে থাকবে, আর কেউ থামবে না।”
নতুনের প্রতি এ আহ্বান রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে এলে ঠিকই দেখতে পেতেন যে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের জাগরণ সারা বাংলাদেশে জুড়ে বিরাজ করছে, যা তাঁকে তৃপ্ত করতো। অর্থাৎ, তিনি মনে করতেন বাঙালী মানুষ হবার পথে এক ধাপ এগিয়ে গেছে।
“সমুদ্রযাত্রা” শীর্ষক আরেকটি প্রবন্ধে তিনি ভারতবর্ষের অচলায়তনের বিরুদ্ধে রীতিমতো ক্ষেপে উঠেছেন। ভারতবর্ষ বসে আছে হাজার হাজার বছর ধরে, অন্যরা তাই এসে ভারতবর্ষে আঘাত করল: “কিন্তু হায়, আমরা সমুদ্র পার না হইলেও মনুর সংহিতা অন্য জাতিকে সমুদ্র পার হইতে নিষেধ করিতে পারে নাই। নূতন জ্ঞান, নূতন আদর্শ, নূতন সন্দেহ, নূতন বিশ্বাস জাহাজ-বোঝাই হইয়া এ দেশে আসিয়া পৌঁছিতেছে। . . . পর্বতকে যদি মহম্মদের নিকট যাইতে নিষেধ কর, মহম্মদ যে পর্বতের কাছে আসে . . .।”
এ অর্থে কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ভৌগোলিক অবস্থানে ঢাকার ঠিক এ্যান্টিপোডাল বা উল্টোদিকে অবস্থান হলো চিলির রাজধানী স্যান্টিয়াগোর। খোঁজ করলে দেখা যাবে সেখানেও বাংলাদেশী বাঙালী কাজ করছে। বস্তুত বাঙালী যুবকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বহুদিন ধরে সমুদ্র পারাপারে ব্যস্ত। আমাদের অচলায়তনগুলো আসলে দ্রুত ভাঙছে।
তারপরও রবীন্দ্রনাথ বলছেন যে শুধু ভৌগোলিক পারপারে মুক্তি আসবে না। মুক্তি আসবে মনের অর্গল খুলে দেওয়ার মাধ্যমে: “কারণ, মনুষ্যত্বের অভ্যন্তরে একটি অমর জীবনের বীজ নিহিত আছে যে, সে যদি কোনো ছিদ্র দিয়া একটুখানি স্বাধীন সূর্যালোক ও বৃষ্টিধারা প্রাপ্ত হয়, অমনি অংকুরিত পল্লবিত বিকশিত হইয়া উঠিতে চেষ্টা করে। সেই ভয়ে আমাদের হিন্দু সমাজ কোথাও কোনো ছিদ্র রাখিতে চাহে না। আমাদের জীবন্ত মনুষ্যত্বের উপরে নিয়মের পর নিয়ম পাষাণ ইষ্টকের ন্যায় স্তরে স্তরে গাঁথিয়া তুলিয়া একটি দেশব্যাপী অপূর্ব প্রকান্ড কারাপুরী নির্মাণ করা হইয়াছে।”
বলাবাহুল্য, উদ্ধৃত অংশটুকুতে শুধু “হিন্দু সমাজ”-এর জায়গায় “মুসলমান সমাজ“ কথাটি বসিয়ে দিলে বাংলাদেশের সমাজের প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠবে। হিন্দু সমাজ যেমন কড়া রক্ষণশীল অনুশাসন ও হুমকি-ধমকীর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সময়কার বাঙালী সমাজকে এগুতে দিচ্ছিলো না, তেমনি ধর্মীয় আচার-আচরণ নিয়ে কিছু ধর্মান্ধ অনুশীলন বাংলাদেশের মুসলমান সমাজকে যে বারবার পর্যুদস্ত করছে না তা নয়। এর একটি অন্যতম আশকারা লক্ষ করা যায় সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী যার মাধ্যমে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করেন। কিন্তু বিশ্ব-ইতিহাস, বর্তমান বিশ্বের অবস্থান এবং রাজনীতির প্রকৃত ধর্ম অনুযায়ী বলা যায় যে একটি রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ধর্মীয় কোন পরিচিতি থাকতে পারে না। সংশোধনীর মাধ্যমে এটা জোর করে চাপালেও এটার কোন কার্যকারিতা থাকে না।
রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন “বিলাসের ফাঁশ” নামক প্রবন্ধে, শুনুন: “এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে, এইজন্য বাহবার স্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন আহার পরিচ্ছেদ, বাড়ি গাড়ি জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম্য ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা।” কিন্তু এ প্রতিযোগিতা শুধু ধনী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এটা সাধারণ লোকের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “এ সমাজ বহুসম্বন্ধবিশিষ্ট।” তাই ধনী পরিবারের চালচালন সাধারণ পরিবারের মধ্যে ঢুকে যেয়ে অস্বসস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেগবান হয়েছে, কিন্তু সাথে সাথে ধনী-দরীদ্রের মধ্যে ব্যবধান বেড়েছে বিস্তর।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। শুনুন: “আমি জানি, এক ব্যক্তি ত্রিশ টাকা বেতনে কর্ম করে। তাহার পিতার মৃত্যু হইলে পর পিতৃবিয়োগের অপেক্ষা শ্রাদ্ধের ভাবনা তাহাকে অধিক পীড়িত করিতে লাগিল। আমি তাহাকে বলিলাম, ‘তোমার আয়ের অনুপাতে তোমার সাধ্য অনুসারে কর্ম নির্বাহ করো-না কেন।’ সে বলিল, তাহার কোন উপায় নাই, গ্রামের লোক ও আত্মীয়কুটুম্বমন্ডলীকে না খাওয়াইলে তাহার বিপদ ঘটিবে। এই দরিদ্রের প্রতি সমাজের দাবি সম্পূর্ণই রহিয়াছে অথচ সমাজের ক্ষুধা বাড়িয়া গেছে।”
ফরাসী দার্শনিক রেনে জিরার অনুকরণশীল ইচ্ছার কথা বলেছেন, যেটি বিরাজ করছে আমাদের দেশেও। লোক-দেখানো সামাজিকতা আমাদের প্রধান সামাজিক ব্যবহারে পরিণত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের খেদোক্তিকে অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু বাঙালী মানুষ হয়েছে বলে মতামত দিয়েছিলেন, কিন্তু কবিগুরুর কথার তাৎপর্য এখনও ফুরিয়ে যায় নি। মানুষ আমরা হতে পেরেছি কই?
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ