আরিফ চৌধুরী »
বাংলা কবিতার অনিবার্য নাম কবি রফিক আজাদ। কবিতার এক রাজপুত্র তিনি। বাংলা কবিতাকে অসামান্য পংক্তিমালায় সমৃদ্ধ করে তিনি কিংবদন্তীতুল্য কবি হিসেবে খ্যাতির শিকড় ছুঁয়েছেন অনায়াসে। বাংলা কবিতায় ষাট দশকের সর্বব্যাপী দুঃশাসন ও নৈরাজ্যের মাঝে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় রফিক আজাদ বাংলা কবিতায় বিস্ময়করভাবে উত্তরণ এবং কবিতার নিরিখে তার কাব্যকর্ম দিয়ে শিল্পিত করে গেছেন বাংলা কবিতার জমিন।
ষাট দশকের বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র কাব্যধারার অধিকারী রফিক আজাদের কবিতা সময় তাড়িত শৈল্পিক চেতনায় কবির ভূবন গড়ে উঠেছিল।
প্রায় অর্ধ শতাব্দীর কাল ধরে কাব্য ভূবনে বিচরণকারী কবি রফিক আজাদ নিজস্ব একটা সমৃদ্ধ কাব্যজগত তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন।
সময়, রাজনীতি, সামাজিক অনাচার, প্রেম, প্রকৃতি, জীবনের বিচিত্র বিষয়, টানাপোড়েন, আবেগের উচ্চারণ, শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে, যা পাঠককে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রেম ও দ্রোহের কবিতায় অনন্ত দু চোখে বয়ে দিয়েছেন ভালোবাসা ও দ্রোহের উচ্চারিত শব্দাবলি। তেমনিভাবে ‘একটা শব্দের জন্য ক্রমাগত তিরিশ বছর’ কবিতায় কবি উচ্চারণ করেছেন আবেগ আশ্রিত শব্দমালা ও স্বপ্ন, কল্পনার ও বেদনার ক্রমাগত হাহাকার। যে হাহাকার তাঁর কেটেছে জীবনের পাওয়া-না পাওয়ার আর্তির মধ্য দিয়ে। যেমন- ‘প্রার্থনায় কেটে গেলো অর্ধেক জীবন
প্রতীক্ষায় চলে যাবে হয়তো বা অবশিষ্ট আয়ু
একটি শব্দের জন্য নষ্ট হলো অর্ধেক জীবন
একটি ফুলের জন্য ভূল হলো জীবন-যাপন
একটি নারীর জন্য ব্যর্থ হবে সমস্ত জীবন।’
(নির্বাচিত কবিতা- রফিক আজাদ)।
প্রেমের ক্রমাগত স্মৃতি ও স্বপ্নের মতো রফিক আজাদের বসবাস। প্রেম ও বেদনায় সদা দেদীপ্যমান, উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠা সময়ের কাতরতা, তাঁকে তাড়িত করেছে নিত্য। প্রেমের গভীরে প্রোথিত কবির তৃষ্ণার্ত মায়াবী উচ্চারণ এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে কবিতার শরীরে। আশা জাগানিয়া স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথে হেঁটে বেড়ানো দিগভ্রান্ত পথিকের মতো। বিচিত্র অনুভবের অন্তহীন প্রকাশ যেনো রফিক আজাদের কবিতার চিরন্তন সৌন্দর্য।
যেমন-‘তুমি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাবে
আমার শরীর মন সবকিছু তা হতে পারে না
যদিও জেনেছি আমি এ রিমোট কন্ট্রোলের যুগ
তোমার আমার মধ্যে হাজার হাজার মাইলের
টেলিফোন তার কিংবা ঐ পুশ বাটন
আর লং ডিস্টেন্স টেলিফোন কল-
ইত্যাদির মধ্যে তোমাকে পাই না আমি।
কণ্ঠ নয়, জলপাই লাবণ্যময় তোমার শরীর
আমি কাছে চাই, পাশে চাই –
দু” বাহুর মধ্যে চাই মৃদু স্বাদু তোমার শরীর।
(হ্যালো রিমোট কন্ট্রোল – রফিক আজাদ)
প্রেমের কবিতায় দেহ ও মনের সর্মপিত প্রকাশের পরিণতিতে রূপ লাভ করে নিয়ত। জীবনযাপনের উদ্দামতায় নর- নারীর প্রেম ও চাওয়া- পাওয়ার আর্তি কাব্যময় অভিব্যাক্তি দেহকে আশ্রয় করে স্বপ্ন কল্পনায় জেগে থাকে, দেহাতীতের উপলব্ধিতে চেতনায় রূপান্তর ঘটে। প্রেমানুভূতির গভীর প্রকাশ প্রেমের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে উপলব্ধির তাড়নায় প্রেমের প্রকাশ ঘটে কবির কবিতার ভিন্নতর শব্দাবলির প্রকাশে, যেমন-
‘যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেবো জীবনের ভুলগুলো;
যদি ভালোবাসা পাই
পাহাড় ডিঙাবো, সমুদ্র সাঁতরাবো।
(যদি ভালোবাসা পাই – নির্বাচিত কবিতা)
এ দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামাজিক অনাচার, অস্থিরতা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের অলাতকাল,ক্ষোভ, হতাশা, জীবনের উন্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কবি পাঁচ দশকের সময়ের শব্দের খেলায় মেতেছিলেন নিরন্তর। সামাজিক অনাচার, দুঃশাসন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার দুরবস্থা, সর্বব্যাপী হতাশা, সামাজিক নৈরাজ্য সব কিছুকে ছাপিয়ে তার কবিতার ভিত্তি গড়ে ওঠে স্বদেশ, মাটি, মানুষ ও মানবতার সংগ্রাম মুখর জীবনের ধারায়।
জীবনের নিরন্তর সংগ্রাম যেনো কবিতার মুল সুর। বাঙালির হাজার বছরের শোষিত আকাঙ্খাকে ধারণ করে কবির উচ্চারণ ‘ভাত দে হারামজাদা’ লাভ করেছে নতুন মাত্রা। শৈল্পিক নিপুণতায় প্রতিবাদী এ শব্দমালা শিল্পের সাধনায় মুক্তির সংগ্রাম ও আর্থ সামাজিক অনাচার, অস্থিরতার মধ্যে এমন নির্মোহ দৃষ্টিতে উচ্চারণ আমাদের কবিতায় উঠৈ আসে নতুন দ্যোতনায়। রাজনৈতিক অস্থিরতায় জীবনে ঘটে যাওয়া বিচিত্র টানাপোড়েন কবির কাব্য যাত্রায় সঙ্গী হয়েছে। বিষাদ, নৈরাজ্য, ক্ষোভ, প্রেম ও প্রকৃতি তার কবিতাকে আচ্ছন্ন করেছে। কবির কবিতায় গণমুখী চেতনা জেগে উঠেছে নিত্য। যুদ্ধোত্তরকালে তার কবিতায় তিনি সমস্ত ভাঙন বিপর্যয় সময়ের সকল যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করে দেশমাতৃকার কল্যানে নিজেকে উৎসর্গ করে কবিতার পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছেন শত্রু নিধনের কলাকৌশল। তাইতো যুদ্ধ সময়ের বেদনা তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
যেমন- ‘টিগারে হাত রেখে, পুনর্বার বুঝে নিতে চাই
অধিনায়কের কন্ঠে উচ্চারিত গাঢ় শব্দাবলী
শপথ প্যারেডে: তোমাদের মনে রাখা প্রয়োজন
এই যুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতক নয়, আজ সৌন্দর্যের প্রকৃত প্রেমিক চাই , তোমাদের কাজ নয় মোটে সহজিয়া। আনন্দের রক্ষণাবেক্ষণ।
অত্যন্ত দুরুহ কর্ম- অনেকের ঘটে অন্তর্জলি।
সত্যের বিরুদ্ধে নয়, আজীবন স্বপক্ষের লড়াই।
(সৌন্দর্য সৈনিকের শপথ প্যারেডে- নির্বাচিত কবিতা)।
রফিক আজাদ আজীবন রোমান্টিক কবি। নারীর প্রেমের কাছে সম্পুর্ণ সমর্পিত কবির ধ্যান ও মন। তবুও নারী ও নির্সগ জীবনের নৈরাজ্য ও বেদনাবোধ তার কবিতায় নবরূপে প্রকাশ পেয়েছে প্রতিনিয়ত।
কবি রফিক আজাদের কবিতার যাত্রাপথ বিশাল ও বিস্তৃত। প্রেম, দ্রোহ, ও মানবতার কবি জীবনের শেষ সময় পর্ষন্ত কাটিয়েছেন কবিতার মধ্য দিয়ে মানবতার জয়গানে। সৃষ্টিশীলতার ঐতিহ্যে তার কাব্যগ্রন্থ বের হয়েছে ধারবাহিকভাবে। ১৯৭৩ সালে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ – অসম্ভবের পায়ে (১৯৭৩), সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে, (১৯৭৪), নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫), চুনিয়া আমার অর্কেডিয়া (১৯৭৭), সশস্ত্র সুন্দর (১৯৮২), এক জীবনে (১৯৮৩), প্রিয় শাড়িগুলো (১৯৮৩), হাতুড়ির নিচে জীবন (১৯৮৪), পরিকীর্ণ পানশালা আমার স্বদেশ (১৯৮৫), খুব বেশি দূরে নয় (১৯৮৬), গদ্যের গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি এক দিকভ্রান্ত পথিক (১৯৮৭), অপর অরণ্য (১৯৮৯), ক্ষমা করো হে নবহমান উদার অমেয় বাতাস (১৯৯২), করো অশ্রুপাত (১৯৯৩), পাগলা গারদ থেকে প্রেমিকের চিঠি (১৯৯৫), কন্ঠে তুলে আনতে চাই (১৯৯৬), বিরিশিরি পর্ব (১৯৯৯), বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে (২০০৬), মৌলভীর মন ভালো নেই (২০০৭) অন্যতম।
মুল্যবোধহীন এই সমাজের সংগ্রামশীল মানুষের জীবন যন্ত্রণা, শ্রেণি বৈষম্যের শিকার হওয়া মানুষের হাতুড়ির নিচে জীবন যাদের তাদের কষ্ট কবিকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় অসহায় মানুষের আর্তনাদ থেকে মুক্তির পথে। তাইতো তার মনোভূমিতে জেগে ওঠে প্রতিবাদের ভাষার মতো কবিতার অনুরণন।
‘ভাত চাই, এ চাওয়া সরাসরি
ঠান্ডা, বা গরম, সরু বা দারুণ মোটা
রেশমি চাল হলে ক্ষতি নেই
মাটির শানকি ভর্তি ভাত চাই,
দূ‘ বেলা দ‘ু মুঠো পেলে ছেড়ে দেবো
অন্য সব দাবি, অযৌক্তিক লোভ নেই
ভাত দে, হারামজাদা নইলে মানচিত্র খাবো।
(ভাত দে হারামজাদা- সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে)
বাংলা কবিতায় ষাট দশকের শক্তিমান কবিরা নিজ নিজ স্বতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। যদিও ষাটের কবিদের উজ্জ্বল অগ্রগামী হলো লিটল ম্যাগাজিন। ষাটের সাহিত্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠাদের মধ্য রফিক আজাদ, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বুলবুল খান মাহবুব, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, শহীদ কাদরী, শহীদুর রহমান, প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার উল্লেখযোগ্য।
যে লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে ষাটের সাহিত্য আন্দোলনে কবিরা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন, তাদের চেতনাকে প্রবাহিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তা হলো রফিক আজাদের স্বাক্ষর ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কন্ঠস্বর পত্রিকাটি।
সমাজ রাজনীতি প্রেম বিশ্বাসের সমস্ত যন্ত্রণাকে ছাড়িয়ে কবি রফিক আজাদ জীবনের মূল্যবোধ, যন্ত্রণা, ও হাহাকারের মধ্যে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যলগ্নতাকে ধারণ করে নিজেকে তৈরি করে নেন অনায়াসেই। সকল কবিতার আত্মমগ্নতা থেকে তিনি উচ্চ কন্ঠে জানান দেন নিজের অস্তিত্ব। তাইতো রফিক আজাদকে বাংলা কবিতার আ্যালেন গিন্সবার্গ বলতে দ্বিধা করেন না কেউ। চির প্রতিবাদী কবি রফিক আজাদ কবিতায় প্রকাশের ধরন ও সুন্দরের স্বপ্ন রচনায়, নারীর প্রতি নির্মোহ ভালোবাসা প্রকাশে সর্বদা নিবেদিত হয়েছেন নির্মোহ ভালোবাসার প্রকাশে। সেই অর্থে রফিক আজাদ বাংলা কবিতার অনিবার্য পুরোধা হয়ে উঠেছেন ও তার কবিতা বাংলা আধুনিক কবিতায় হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর।