একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ শুধু পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করত। মোট রপ্তানি আয়ের ৯৭ শতাংশই আসত এ খাত থেকে। এজন্য পাটকে ‘সোনালি আঁশ’ হিসেবেও অভিহিত করা হতো। তবে কালের পরিক্রমায় পাটের সে অবস্থান আর নেই। অনেক বছর হলো রপ্তানিতে পাটের জায়গা দখল করে নিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। গত দুই দশকে দেশের খাতভিত্তিক রপ্তানি আয়ের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০০৫ সময়কালে প্রতি বছর গড়ে ৫০২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময় মোট রপ্তানিতে খাতটির অবদান ছিল ৭৫ দশমিক ২ শতাংশ। এর পরের দশকে ২০১৮ থেকে ২০২৩ সময়পর্বে পোশাক খাতের বার্ষিক গড় রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬৬২ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এ সময়ে রপ্তানিতে খাতটির হিস্যা আরো বেড়ে ৮৩ শতাংশে দাঁড়ায়। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ওভেন ও নিট মিলিয়ে ৩ হাজার ৯৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ সময়ে মোট রফতানির ৮১ দশমিক ৪৯ শতাংশ অবদান ছিল তৈরি পোশাক খাতের।
পণ্যে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে দেশের রফতানি আয় বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু বাস্তবে এসব উদ্যোগ তেমন কাজে আসেনি। বরং রপ্তানিতে হিমায়িত খাদ্য, পাট ও চামড়া খাতের অবদান ক্রমেই আরো হ্রাস পেয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানিতে তৈরি পোশাক খাতের আধিপত্য প্রবল হয়েছে। এ খাতের ওপর ভর করে দেশের রপ্তানি আয়ও অনেক বেড়েছে। যদিও একক খাতের ওপর রপ্তানি আয় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় তা দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি তৈরির পাশাপাশি হয়ে উঠেছে ভূ-অর্থনৈতিক চাপের অনুষঙ্গও। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে ট্যারিফ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষির সময় তৈরি পোশাক খাতনির্ভরতা ও ভূ-অর্থনৈতিক সমীকরণের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজার। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলো রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বার্তা দেয়ার কৌশল হিসেবে এ নির্ভরতাকে ব্যবহার করতে পারে।
এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক দেশ এখন বোঝে যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে যদি আঘাত করা হয় তাহলে অনেক কিছু আদায় করা সম্ভব। অর্থাৎ বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন একটা ভূ-অর্থনৈতিক অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি বাংলাদেশকে আঘাত করতে চায়, পোশাক খাতকে আঘাত করে সেটি সম্ভব। কিছু পক্ষ মনে করে যে পোশাক খাতকে অস্থির রাখলেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর হবে এবং তাদের দাবি আদায় করা সহজ হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম মনে করেন, আজকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আইএলও আমাদের বাণিজ্য সুবিধাকে পুঁজি করে যেসব শর্ত পরিপালনে চাপ দিচ্ছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন ২০ জন সদস্য হলেই ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে, এটা চরম আপত্তিকর। এসব শর্ত মোকাবেলা করে শিল্প আর এগিয়ে যেতে পারে না।
আমরা মনে করি, রপ্তানি বাণিজ্যের ঝুঁকি কমাতে বিকল্প পণ্যের অনুসন্ধান করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। না হলে ভবিষ্যতে টেকসই অর্থনীতির স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়বে।