কামরুল হাসান বাদল »
আজকের এই উজ্জ্বলতম সন্ধ্যায়, সড়কে জ্বলে থাকা নিয়নবাতির আলোয় ভেসে যাওয়া নগরের এই রূপ দেখে কোনো কিশোর-তরুণ বা যুবক কল্পনাও করতে পারবে না ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বরের দিনটি কিংবা সন্ধ্যাটি কেমন ছিল।
আজকের ঝলমলে যে বাংলাদেশকে দেখছে ওই প্রজন্ম তারা কল্পনাও করতে পারবে না ৫২ বছর আগের বাংলাদেশ কেমন ছিল। কত মৃত্যু, কত ধ্বংস, কত আত্মদান, কত তিতিক্ষার বিনিময়ে আজকের এই বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছে, বর্ণাঢ্য ও বর্ণিল হয়েছে। এই সন্তানেরা ভাবতেও পারবে না কী হত্যা ও ধ্বংসলীলার মুখে এদেশের প্রায় এক কোটি শিশু-নারী-পুরুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। লাখ লাখ তরুণ মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে, কখনো আর ফিরে আসা হবে না জেনেও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতকে উপেক্ষা করে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মতো আধুনিক ও হিংস্র বাহিনীর সামনে অসীম সাহসের সাথে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সে এক মহাজাগরণের ক্ষণ, সে এক মহাকাব্য রচনার ক্ষণ, সে এক ইতিহাস রচনার ক্ষণ। বাঙালির প্রথম একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে এক বিশাল জনসমুদ্রে ডাক দিয়েছেন স্বাধীনতার।
কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় সে অসামান্য সময়ের কথা উঠে এসেছে এভাবে-
একটি কবিতা লেখা হবে
তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে :
“কখন আসবে কবি?”
একটি কবিতা পড়া হবে,তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : “কখন আসবে কবি?” “কখন আসবে কবি?”
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসুর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
সেই থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের।
সে থেকে অবিরাম অবিশ্রান্তভাবে বাঙালি স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
ডিসেম্বরের শুরু থেকেই পাকিস্তানি জান্তার পরাজয়ের আভাস স্পষ্ট হতে থাকে। দেশের কিছু কিছু অঞ্চল থেকে শত্রুসেনারা পিছু হটতে থাকে। স্বাধীনতা শব্দটি জনগণের হয়ে উঠতে থাকে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক