রংতুলিতে অমর একুশ

জোবায়ের রাজু »

১৪ বছরের রাতুল অসাধারণ ছবি আঁকে। এই বয়সে সে এত নিখুঁত ছবি আঁকে যে তার স্কুলের স্যারেরা মুগ্ধ হয়ে যায়। ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক বলে বাবা রাতুলকে রংতুলি ও ক্যানভাস কিনে দিলেন সেও অনেক দিন হলো। ছবি আঁকার এই সরঞ্জাম দুটি পেয়ে রাতুলের আনন্দ কে দেখে!
খেলাধুলার প্রতি সেরকম কোনো ঝোঁক নেই রাতুলের। একটা সময়ে সে গান করতো। নিয়মিত গানের ক্লাসেও যেত। গানের ওস্তাদের আকস্মিক মৃত্যুর কারণে গানের স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য বাবা রাতুলের জন্য বাসায় গানের টিচার নিয়োগ করেছেন। তরুণ বয়সের সেই গানের টিচার প্রতি শুক্রবারে বিকেলে নিয়ম করে রাতুলকে গান শেখাতে আসতেনক্ষ এভাবে চারমাস কাটার পর একদিন সে গানের টিচারসহ পুরো পরিবার আমেরিকা চলে যাবার পর গানের সাথে দূরত্ব বাড়ে রাতুলের। কিন্তু ছবি আঁকার প্রতি যে রাতুলের ঘোর এক আকর্ষণ, ফলে সে আগে যে সময়টুকুতে হারমোনিয়ামের সামনে বসে গলা সাধতো, সে সময়টুকুতে ছবি আঁকার সাধনা করতে থাকে। বাবা বুঝে নিয়েছেন তার এই সৃষ্টিশীল ছেলে চমৎকার ছবি আঁকে। ফলে বাবা রাতুলকে ছবি আঁকার ব্যাপারে বাধা না দিয়ে বরং অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।
অনেকগুলো ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় জিতেছে রাতুল। ঘরে সেসব পুরষ্কার সাজিয়েও রাখা আছে। এবার জেলা পর্যায়ে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে রাতুলক্ষ কিন্তু প্রতিযোগিতায় কী ছবি আঁকবে, সেটা তদন্ত করতে ক্যানভাসের সামনে বসে আছেক্ষ রংতুলির ছোঁয়ায় আঁকতে থাকে গ্রামের ছবি, ফুলের ছবি, পাহাড়ের ছবি, কিন্তু কোনো ছবিই মনের মত হয় না রাতুলের। দাদু ভাই পাশে এসে বসেন। হাইপাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে হানিফ খানের তীক্ষ্ণ চোখ পরখ করছে নাতি রাতুল কী আঁকিবুঁকি করছে। দাদু ভাইকে দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে রাতুল বলল,
‘প্রতিযোগিতায় কী আঁকবো ভেবে পাচ্ছি না দাদু!’
হানিফ খান কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, ‘ভাষা আন্দোলনের ছবি আঁকো। রক্তে রঞ্জিত রাজপথ, বেপরোয়া গুলির আক্রমণ, এসব আঁকতে পারো দাদু ভাই!’
রাতুল জানতে চায়, ‘হঠাৎ এসব আঁকার প্রসঙ্গ কেন দাদু ভাই?’
হানিফ খান ভরাট গলায় বললেন, ‘কারণ আমি ৫২-এর ভাষা সৈনিক। সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যোগ দিলাম মিছিলে। সাথে আমার বন্ধু এমদাদও ছিল। বেপরোয়া বুলেট ছোঁড়া হয় সে মিছিলে। রফিক, সফিক, সালাম, বরকতের ছিন্নভিন্ন লাশের ভেতরে যে লাশটি অবহেলায় পড়ে রয়েছিল, সে লাশটি আমার বন্ধু এমদাদের।’
রাতুল প্রশ্ন করে, ‘তাহলে সালাম, রফিক, শফিকদের নামের পাশে ভাষা সৈনিক, এমদাদের নাম কেন বলা হয় না?’
হানিফ খান বলেন, ‘ওরা ইতিহাস দাদু ভাই। এমন অসংখ্য ভাষা সৈনিক আছেন, যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় নেই। আমার বন্ধু এমদাদ তার বড় প্রমাণ।’
হানিফ খান রাতুলকে ভাষা আন্দোলনের গল্প বলতে বলতে স্মৃতিতে হারিয়ে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে থাকলেন ১৯৫২ সালকে। ফেব্রুয়ারি মাস তখন। বাংলা ভাষায় অস্তিত্ব রক্ষার্থে রাজপথে তখন মিছিলের বিকট ধ্বনি। পোস্টার হাতে নিয়ে হানিফ খান মিছিলে সমাগত। পোস্টারে বড় বড় অক্ষরে লেখা- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ হানিফ খানের বামপাশে তার বন্ধু এমদাদ বজ্রকণ্ঠে মিছিলের স্লোগান দিচ্ছে। হঠাৎ একটি বুলেট এসে বেঁধে তার বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ হারান এমদাদ।
ভাষা আন্দোলনের সেই তাণ্ডবলীলায় অনেকে মারা যান। অনেকে প্রাণেও বেঁচে যান। হানিফ খান প্রাণে বেঁচে গেলেন। অসংখ্য ভাষা সৈনিকদের ভিড়ে যারা প্রাণ হারিয়েও ইতিহাসের অংশ হতে পারেননি, এমদাদ তাদের মধ্যে একজন। রাতুলকে একুশের এই গল্প বলতে বলতে অশ্রুতে ভিজে গেলেন হানিফ খান। কাঁপা গলায় নাতিকে বললেন, ‘তুমি ওই ক্যানভাসে এমদাদের ছবি আঁকো দাদু ভাই। সব চিত্রশিল্পীরা ঘুরে ফিরে রফিক, শফিকদের ছবি আঁকে। তুমি আঁকবে এমদাদের ছবি।’
রাতুল রংতুলিতে একুশের ছবি আঁকতে থাকে। রাতুলের ক্যানভাসে ধীরে ধীরে শোভা পাচ্ছে একটি লাশের ছবি। লাশটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। লাশের বুক থেকে রক্ত ঝরছে। পাশে পড়ে আছে একুশের বড় একটি পোস্টার। পোস্টারে লেখা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই!’ সে লেখার হরফে লাল লাল রক্তের ফোঁটাক্ষ রাতুলের আঁকা ছবিটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। হানিফ খান নাতির চিত্রকর্ম দেখছেন। রাতুল তার কল্পনার অনুভূতি দিয়ে একমনে ছবি আঁকছে। ছবির আঁকা লাশটি বন্ধু এমদাদ কল্পনা করে হানিফ খান অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। তার মনের পর্দায় বেদনা হয়ে ধরা দিল সেই ৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারির লোমহর্ষক ঐতিহাসিক দিনটিক্ষ।