যে পাখি পানিতেও হাঁটে

শেখ আনোয়ার :

ভুশ করে পানির নিচ থেকে ভেসে উঠলো কয়েকটি মাথা। পর মুহূর্তে শরীর। দেখা গেলো নয়টি পাখি। বুনোহাঁসের মতো আকার আকৃতি।

তবে ঠিক হাঁস নয়। পা আর ঠোঁট অনেকটা হাঁসের মতো। চামচের মতো ঠোঁট। কুচকুচে কালো। তবুও এতো ধারালো যেনো ছুরির ফলা। চোখজোড়া চুনির মতো লাল। মাঝখানে শুধু কালো একটা বিন্দু।

পাখিগুলো হঠাৎ ডানা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেলো পানির ওপর। লম্বা গলাটা বাঁকিয়ে দিলো ফণা তোলা সাপের মতো। তারপর ছপ ছপ করে পানি ছিটিয়ে ছুটতে শুরু করলো সামনের দিকে।

পাখির নাম স্পুনবিল। পৃথিবীতে যতো জলচর পাখি রয়েছে, এদের ভেতর শুধু এ স্পুনবিল পানিতে দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারে। দেখলে মনে হবে যেন দ্রুতগতিতে পানিতে হেঁটে যাচ্ছে ওরা। আমরা যেভাবে স্বচ্ছন্দে মাটিতে হেঁটে থাকি, এদের পানির ওপর হাঁটাহাঁটিও তেমনি স্বাভাবিক।

স্পুনবিলের বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘প্লাটেলিয়া মাইনর’। উচ্চতা ষাট থেকে তিরাশি সেন্টিমিটার। আর ওজন মাত্র দেড় কেজির মতো। তাইওয়ানের বিস্তীর্ণ জলাভূমি স্যাংগুয়েনে শীতকালে দেখা যায় এ জলচর পাখিগুলোকে। উপকূলবর্তী অঞ্চলে এদের বসবাস। এরা উড়তে যেমন সুপটু, তেমনি সাঁতারেও সুদক্ষ।

দল বেঁধে চলে এরা। আর পানিতে তাক লাগানো ছুটে চলায় তো জুড়ি নেই। সাধারণত ছোট ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে অনেকক্ষণ। ফলে মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ও শামুক শিকার সহজ হয় এদের।

স্পুনবিলের ডাক অনেকটা ঝিঁঝিঁ পোকার মতো। ক্রী ক্রীট। ক্রী ক্রীট। এভাবে ছন্দময় ভঙ্গিতে ডাকে এরা। বাসা বাঁধে পানির ওপর। জুটি বাঁধা মেয়ে আর পুরুষ পাখি মিলে জলজ আগাছা দিয়ে ভাসমান বাসা তৈরি করে পানিতে। সাধারণত পানির নিচ থেকে তুলে আনে বাসা তৈরির এ উপকরণ।

জুন মাসের শুরুতে বাসা তৈরির ধুম পড়ে যায়। মেয়ে স্পুনবিল তিন থেকে চারটে নীলচে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে ডিমগুলো ধবধবে সাদা হয়ে যায়। জুটি হিসেবে এ পাখির টিমওয়ার্ক খুবই চমৎকার। বাসা তৈরি, ডিমে তা দেয়া আর বাচ্চা লালন-পালনে নারী-পুরুষ দুটোই সমান কাজ করে থাকে।

সপ্তাহ তিনেক পালাক্রমে ডিমে তা দেয়ার পর ছানা বেরিয়ে আসে। ছানাগুলো তখন এ পাখির বিশেষ এক থলেতে আশ্রয় নেয়। পাখির পাখা আর পিঠের পালক দিয়ে তৈরি হয় এ থলে। ডিম ফুটে সব বাচ্চা বেরিয়ে ওই থলেতে উঠে এলে বাসা ফেলে পানিতে নেমে আসে পুরো পরিবার। এসময় মা আর বাবা পাখি ছানাগুলোর ভাসমান বাসা হিসেবে কাজ করে।

বাবা পাখিটি ডুব দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরে এনে ছানাগুলোর মুখে তুলে দেয়। তাইওয়ান ছাড়াও চীন, ম্যাকাও, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাগর উপকূলে এখন পর্যন্ত ছয়শ তেরোটা স্পুনবিল টিকে রয়েছে। এ পাখির বিলুপ্তির বিষয় নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এখন বড়ই চিন্তিত।

লেখক পরিচিতি: শিশুদের মাঝে বিজ্ঞানকে সহজ ও জনপ্রিয়করণের কাজে নিবেদিত শেখ আনোয়ার। শিশুসাহিত্য ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নিয়ে লেখালেখি করছেন প্রায় দুই যুগ ধরে। শিশু অ্যাকাডেমি সাহিত্য পুরস্কারজয়ী এ লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬৪।

 

বিডিনিউজের সৌজন্যে