শেখ এ কে এম জাকারিয়া :
গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি অনুসারে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ইংরেজি বর্ষ উদযাপন হয়ে থাকে। গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডারের আগে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির প্রয়োগ ছিল এই পৃথিবীতে। জুলিয়ান বর্ষপঞ্জিরও পূর্বে ভ্যাটিক্যান পোপের অনুসারী খ্রিস্টান ধর্মসম্প্রদায়বিশেষ অর্থাৎ রোমের অধিবাসীরা গ্রিক পঞ্জিকা অনুসারে ৩০৪ দিনে বছর ধরত। যা ১০ মাসে বিভক্ত ছিল। এই সময়ের ইংরেজি বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির জন্ম তখনও হয়নি। সে সময়ে মার্চ ছিল বছরের প্রথম মাস। পরবর্তী সময়ে রাজা নুমা পম্পিলিয়াস খেয়াল করেন ৩০৪ দিন হিসেবে বছর ধরলে পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। সে কারণে তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৭৯৩ অব্দে বছরের সঙ্গে যুক্ত করেন আরও ৬০ দিন। মোট হলো ৩৬৪ দিন। কিন্তু দিন বাড়ানোর পরে সমস্যা আরও বেড়ে গেল। ঋতুর চেয়ে সময় এগিয়ে আছে তিন মাস।
সম্রাট জুলিয়াস সিজার ওপরে বর্ণিত সমস্যা দূর করতে নিজের মতো করে সাজালেন বছরকে। নতুন দু’মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে বছরের শুরুর দিকে নিয়ে এলেন। এবার দেখা যাক কীভাবে এলো এই ইংরেজি বছরের বারোমাসের নাম।
জানুয়ারি : গ্রেগারীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি। এ সম্পর্কে বইপত্রাদি ঘেঁটে যতদূর জানা যায় তা হলো, ইউরোপের রোম নগরীতে ‘জানুস’ নামে এক দেবতা ছিলেন। রোমের অধিবাসী এই দেবতাকে আরম্ভের দেবতা হিসেবে পুজো দিত। কোনো কিছু শুরু করার আগে তারা এই দেবতার নাম খুবই সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করত। আর এ কারণেই ইংরেজি বছরের প্রথম মাসের নামটি দেবতা ‘জানুস’-এর নামে রাখা হয়। অন্য একটি তথ্য মতে, দেবতা ‘জানুস’ এর দুটি মুখ ছিল। একটি সম্মুখে, অপরটি পশ্চাতে। রোমের অধিবাসীরা বিশ্বাস করত, সামনের মুখটি তাকিয়ে আছে আগামীকালের অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে, আর পেছনের মুখটি বিগতকালের অর্থাৎ চলে যাওয়া অতীতের দিকে। কেউ কেউ মনে করেন, পূর্বোক্ত মতের সঙ্গে মিল রেখে জানুয়ারিকে ইংরেজি বছরের প্রথম মাস করা হয়।
ফেব্রুয়ারি : গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারি। ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে যে বিশ্বাস মানুষের অন্তরে লালিত তা এ রকম : খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৪৫০ বছর পূর্বে দ্বিতীয় মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারির ব্যবহার ছিল। বহুকাল পূর্বে রোমের অধিবাসীরা ‘ফেব্রুয়া’ নামে মনের মলিনতা দূরীকরণ অর্থাৎ হৃদয় শুদ্ধ করার উৎসব পালন করত। ‘ফেব্রুয়া’ মানে শুদ্ধ। রোমে বসবাসরত লোকজন তাই এ মাসটিকে শুদ্ধতার মাস মনে করে।
মার্চ : ইংরেজি বছরের তৃতীয় মাস মার্চ। রোমান যুদ্ধদেবতা ‘মারস’-এর নামানুসারে মার্চ মাসের নামকরণ হয়। যুদ্ধদেবতার নামে এ মাসের নামকরণ হওয়াতে অনেকেই এ মাসকে সামরিক কুচকাওয়াজের মাসও বলে থাকেন।
এপ্রিল : ইংরেজি বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল। বছরের চতুর্থ মাস এপ্রিল-এর নামকরণ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। অনেকের মতে, এ মাসটি রোমানদের প্রেমের দেবী ‘ভেনাস’-এর কাছে উৎসর্গ করা হয়েছে এমন একটি মাস। ‘ভেনাস’ শব্দটিকে গ্রিক ভাষায় ‘অ্যাফ্রোডাইটি’ (অঢ়যৎড়ফরঃব) বলা হয়, যা থেকে এপ্রিল (অঢ়ৎরষ) শব্দটির জন্ম। এছাড়া অন্য মতও আছে। বসন্তের প্রবেশ পথ খুলে দেওয়াই এপ্রিলের কাজ। তাই কারও-কারও ধারণা, ল্যাটিন শব্দ ‘এপিরিবি’ (যার অর্থ খুলে দেওয়া) থেকে ‘এপ্রিল’ শব্দটি এসেছে।
উল্লে¬খ্য, এ মাসেই ১ এপ্রিলে ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস পালন করা হয়। বসন্ত শুরুর প্রথম দিনের আনন্দানুষ্ঠানকে স্মরণ রাখতে পহেলা এপ্রিলকে ‘সব বোকাদের দিন’ বা অষষ ঋড়ড়ষং উধু হিসেবে পালন করার রীতি বহুকাল পূর্বে থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রতীচ্যের এ ধারা অনুযায়ী ‘এপ্রিল ফুল’ দিবস হচ্ছে পহেলা এপ্রিলে কাউকে কৌতুক করে ঠকানো বা বোকা বানানো।
মে : ইংরেজি বছরের পঞ্চম মাস মে। ইউরোপে বসবাসরত রোমানদের দেবী ‘মায়া/ মেইয়া’-এর নামানুসারে মাসটির নামকরণ হয় মে। এই মায়া ছিলেন গ্রিকপুরাণে বর্ণিত পৃথিবী ধারণকারী ‘এটলাস’-এর আত্মজা। ভারতীয় ইতিহাসের আনুমানিক ১১শ থেকে ১৫শ শতাব্দীতে অর্থাৎ মধ্যযুগে যুক্তরাজ্যে পহেলা মে তারিখটি একজন ‘মে-কুইন’ অভিষিক্ত করার আনন্দানুষ্ঠান হিসেবে পালন করা হতো। অন্যদিকে ১৮৮৯ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে সংঘটিত শ্রমিক আন্দোলনের স্মারকচিহ্ন হিসেবে পহেলা মে দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণির ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে পহেলা মে দিবসটি আন্তর্জাতিক ছুটির দিন।
জুন : ইংরেজি সালের ষষ্ঠ মাস জুন। জুন মাসের নামকরণের উৎস নিয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, ‘জুনিয়াস’ নামে কোনও একটি রোমান পরিবারের নাম থেকে ‘জুন’ শব্দটির প্রকাশ। তবে এটা সত্য যে, সবচেয়ে বেশি চলিত মত হলো, ‘জুন’ নামটি এসেছে গ্রিক দেবরাজ জুপিটারের রানি জুনো-এর নাম থেকে। যাঁকে নারী, চাঁদ ও শিকারের দেবী বলা হতো। যিনি ময়ূরবাহিত চাকাযুক্ত যানে চড়ে যাতায়াত করতেন। তাছাড়া জানা যায়, অনাধুনিক রোমে জুন মাসের শুরুতে দেবী জুনোর সম্মানে আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।
জুলাই : গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির সপ্তম মাস জুলাই। জুলিয়াস সিজারের নামে এ মাসের নাম রাখা হয়েছে জুলাই। এখানে রহস্যাবৃত বিষয় এটাই যে, বছরের প্রথমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে স্থান দিয়ে জুলিয়াস সিজার নিজেই নিজেকে দূরে সরিয়ে দেন।
আগস্ট : গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের অষ্টম মাস আগস্ট। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের পর রোম সাম্রাজ্যের সম্রাট হন তাঁরই ভাইপো অগাস্টাস সিজার। তাঁরই নামে এ মাসটির নাম রাখা হয় আগস্ট।
সেপ্টেম্বর : সেপ্টেম্বর শব্দের ব্যাকরণসম্মত অর্থ সপ্তম। কিন্তু সম্রাট জুলিয়াস সিজার কর্তৃক বছরের মাসগুলো সাজানোর পর তা এসে দাঁড়ায় নবম মাসে। ইংরেজি বছরের এই নবম মাস, পরে আর কেউ পরিবর্তন করেনি।
অক্টোবর : ইংরেজি বছরের দশম মাস অক্টোবর। অথচ এ মাসের ব্যাকরণ-অনুমোদিত অর্থ অষ্টম। সেই মতে এটা অষ্টম মাস হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে এ মাস আমাদের খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জিতে দশম মাসে স্থান পেয়েছে ।
নভেম্বর : নভেম্বর হচ্ছে গ্রেগোরীয় বর্ষপঞ্জির এগারোতম মাস। অথচ ‘নভেম’ শব্দের অর্থ ‘নয়’। সে যুক্তিতে সুদূর অতীতে নভেম্বর ছিল নবম মাস। জুলিয়াস সিজারের কারণে নভেম্বরের স্থান নয়ের বদলে এগারোতে গেল।
ডিসেম্বর : গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অর্থাৎ ইংরেজি বছরের দ্বাদশ বা শেষ মাস ডিসেম্বর। কিন্তু ল্যাটিন শব্দ ‘ডিসেম’ অর্থ দশম। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের বর্ষ সাজানোর আগে, অর্থানুসারে এটি ছিল দশম মাস। কিন্তু আজ আমাদের কাছে এ মাসের অবস্থান ক্যালেন্ডারের শেষভাগে।
উল্লেখ করা দরকার, জুলাই ও আগস্ট এ মাস দুটোর নাম পূর্বে ছিল কুইন্টিলিস ও সিক্সিলিস। অর্থাৎ পঞ্চম ও ষষ্ঠ। জুলিয়াস সিজার রোমের সম্রাট হয়ে নিজের নামটিকে ইতিহাসের পাতায় বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ করার জন্য পঞ্চম মাস কুইন্টিলিস-এর পরিবর্তে নিজের নামে জুলিয়াস রাখেন। এতেও তিনি নিবৃত্ত হলেন না, আরও মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য ৩০ দিনের জুলিয়াস মাসকে করেন ৩১ দিন। কিন্তু বছর তো আর ৩৬৫ দিন থেকে বেড়ে ৩৬৬ দিন হতে পারে না। যার কারণে রোমান পুরোহিতেরা ফেব্রুয়াারি মাসকে ৩০ দিন থেকে কমিয়ে ২৯ দিন করতে বাধ্য হলেন।
জুলিয়াস সিজারের পর ররামের সম্রাট হন তাঁরই ভাইপো অগাস্টাস সিজার। পুনর্বার অস্ত্রোপচার চালানো হয় ফেব্রুয়ারির ওপর। সেই থেকে ফেব্রুয়ারি ২৮ দিনে এসে দাঁড়ায়। অগাস্টাস সিজার এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, লিপইয়ার বছরে আগস্ট মাসটিকে ৩২ দিনে গুনতে হবে। রোমে এ ব্যবস্থা চালু ছিল অনেকদিন। পরে তা ৩১ দিনে আসে। আর এভাবেই দীর্ঘ সময় এবং নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মানবজাতি পেয়েছে ইংরেজি বছরের বারোমাসের নামকরণের রোমাঞ্চকর ইতিহাস।