যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে লেবার পার্টির নিরঙ্কুশ বিজয়

যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার ও তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া স্টারমার

সুপ্রভাত রিপোর্ট »

যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে বিপুল জয় পেল লেবার পার্টি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ কমন্স’-এ মোট আসন ৬৫০। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রয়োজন ৩২৬ আসন। ফলাফল ঘোষিত হয়েছে ৬৪৮টি। প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জানা যাচ্ছে, লেবার পার্টি ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে। আর কনজারভেটিভ পার্টির ঘরে গেছে ১২১ টি আসন।

২০১৯ সালের তালিকা থেকে টোরিরা ২৫০ টি আসন খুইয়েছে এবার। আর লেবাররা গত নির্বাচনের তুলনায় ২১১ টি আসন বেশি পেয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ৭১টি আসন পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। এর বাইরে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নয়টি আর রিফর্ম ইউকে চারটি আসন নিজেদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়েছে।

রক্ষণশীলদের ১৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাজের ক্ষমতায় ফিরছে মধ্য বামপন্থি দল লেবার পার্টি। ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ভরাডুবি হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৯৮টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ৩৫টি রাজনৈতিক দল মাত্র একজন করে প্রার্থী দেয়। রেকর্ড ভেঙে এবার ৪ হাজার ৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৩১৭টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৫৯ জন।

যুক্তরাজ্যে এবারের সাধারণ নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নে প্রার্থী হন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।

লেবার নেতা হিসেবে যুক্তরাজের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন ৬১ বছর বয়সী কিয়ার স্টারমার, যিনি হবেন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের নতুন বাসিন্দা।

কে এই কিয়ার স্টারমার

ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন ৬১ বছর বয়সী কিয়ার স্টারমার। এই আইনজীবীকে নাইট উপাধী দিয়েছিলেন প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ২০১৫ সালে তিনি প্রথম লন্ডন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে হতাশাজনক ফলের পরে দলের নেতা হয়েছিলেন স্টারমার।

২০০৮ থেকে ২০১৩ স্টারমার ছিলেন ডিরেক্টর অফ পাবলিক প্রসিকিউশন। ১৯৬২ সালে লন্ডনের উপকণ্ঠে জন্ম নেওয়া স্টারমার। বেড়ে উঠেছিলেন সারে-র অক্সটেড শহরে। তাঁর মা ছিলেন নার্স এবং বাবা কারিগর। স্টারমারের মা-বাবা দু’জনেই লেবার সমর্থক ছিলেন। স্টারমাররা চার ভাই-বোন ছিলেন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। পরে লিডস বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি।

রাজনীতির মাঠে সাড়া ফেলে দেওয়া স্টারমার একজন দক্ষ ফুটবলার। ক্লাব ফুটবলে আর্সেনালের ভক্ত তিনি। ফৌজদারি বিচার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখায় ‘নাইট’ উপাধি পেয়েছেন স্টারমার।

সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম দ্য সান আয়োজিত এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে স্টারমার বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে যেসব মানুষ আসছেন, তাঁদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না।’ কনজারভেটিভ সরকারের রুয়ান্ডা অভিবাসী প্রত্যাবাসন প্রকল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

স্টারমারের এমন মন্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়ে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি সম্প্রদায়। প্রতিবাদ জানানো হয়। এমন মন্তব্যে বিপাকে পড়েন এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। এবার লেবার পার্টির আটজনসহ সব মিলিয়ে অন্তত ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক ভোটে লড়ছেন।

তুমুল সমালোচনার মুখে সুর নরম করেন স্টারমার। তিনি বলেন, ‘আমি আসলে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে বোঝাতে চাইনি। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আমাদের দেশের প্রতি বাংলাদেশি কমিউনিটির অবদানকে আমি ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করি।’

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্টারমারকে ডাউনিং স্ট্রিটে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে। ভোটের আগে তিনি এক শব্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার করেছেন। তা হচ্ছে—পরিবর্তন।

কী বার্তা হবু প্রধানমন্ত্রী স্টারমারের

ভোটে জিতে স্টারমার বলেন, ‘১৪ বছর পর ফের ব্রিটেন নিজেদের ভবিষ্যত ফিরে পেয়েছে। আমরা এটা করে দেখিয়েছি। আপনারাই এর জন্যে প্রচার করেছিলেন। এই জয়ের পক্ষে লড়াই করেছিলেন। আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন এবং এখন সেই মুহূর্ত এসে গিয়েছে। সত্যি বলতে, খুবই ভালো লাগছে।’ তাঁর কথায়, ‘ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা পরিবর্তন চাইছেন। সব কিছুই ভোটারদের মাধ্যমে হয়। এই সমাজ থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হবে।’

জিতলেন সুনক, দলের পরাজয় স্বীকার করে নিলেন

কনজ়ারভেটিভ পার্টি শোচনীয় ভাবে পরাজিত হলেও নিজের রিচমন্ড অ্যান্ড নর্থঅ্যালার্টন আসনে জিতলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটেনের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক।

শুক্রবার সকালেই দলের সমর্থকদের উদ্দেশে সুনক বলেন, “লেবার পার্টি সাধারণ নির্বাচনে জিতেছে। আমি কিয়ের স্টারমারকে ফোন করে এই জয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আজই শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি দুঃখিত। আমি এই পরাজয়ের দায় স্বীকার করছি।”

 

টিউলিপ সিদ্দিকের বড় জয়

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন টিউলিপ সিদ্দিক। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৌহিত্রী।

হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট আসনে লেবার পার্টির প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়েন টিউলিপ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ প্রার্থীর চেয়ে টিউলিপ প্রায় দ্বিগুণ ভোটে জিতেছেন।

টিউলিপ পেয়েছেন ২৩ হাজার ৪৩২ ভোট। এই জয়ের মাধ্যমে তিনি টানা চতুর্থবারের মতো এমপি নির্বাচিত হলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ডন উইলিয়ামস পেয়েছেন মাত্র ৮ হাজার ৪৬২ ভোট।

টিউলিপের মা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা। টিউলিপ প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন ২০১৫ সালে।

রুশনারা আলী টানা পঞ্চমবার জিতলেন

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রুশনারা আলী যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে টানা পঞ্চমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি আসন থেকে জিতেছেন রুশনারা। রুশনারা ১৫ হাজার ৮৯৬ ভোট পেয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আজমল মাশরুর পেয়েছেন ১৪ হাজার ২০৭ ভোট। লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির প্রার্থী রাবিনা খান ৪ হাজার ৭৭৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা। লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের এই আসনে ২০১০ সাল থেকে টানা এমপি নির্বাচিত হয়ে আসছেন তিনি।

রুশনারার জন্ম সিলেটে। বয়স যখন সাত বছর, তখন যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমায় তাঁর পরিবার। তিনি অক্সফোর্ডের সেন্ট জনস কলেজ থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

ফিলিস্তিনপন্থি আদনানের জয়

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে দেশটির উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় ব্ল্যাকবার্নে লেবার পার্টির প্রার্থী কেট হলার্নকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছেন ফিলিস্তিনপন্থি স্বতন্ত্র প্রার্থী আদনান হোসেইন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধ নিয়ে লেবার পার্টির অবস্থান নিয়ে দলটির অনেক ভোটারের মধ্যে যে বিভক্তি ও অসন্তোষ রয়েছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী আদনানের জয়ে তারই প্রতিফলন হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।

রাজনীতিতে নতুন আসা আদনান ভোট পেয়েছেন ১০ হাজার ৫১৮টি। আর পরাজিত প্রার্থী হলার্ন পেয়েছেন ১০ হাজার ৩৮৬ ভোট। অর্থাৎ, ১৩২ ভোটে হলার্নকে হারিয়ে দেন আদনান।

ব্ল্যাকবার্ন আসনটিতে ৬৯ বছর ধরে প্রতিনিধিত্ব করছেন লেবার পার্টির আইনপ্রণেতারা।

৩৪ বছর বয়সী আদনান পেশায় আইনজীবী। নির্বাচনে গাজাপন্থি প্ল্যাটফর্ম থেকে দাঁড়ান তিনি। তাকে সমর্থন দেয় সাবেক লেবার কাউন্সিলরদের একটি দল। লেবার দলের গাজা নীতিকে ঘিরে দলটি থেকে সরে যান এই কাউন্সিলররা।