যাযাবর

সবুজ মণ্ডল »

খেই হারানো বাতাসের বিপরীতে আলগোছে চলছে শ্যালো নৌকা, লেকের পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ তনু’র কান অবধি গেলেও মগজে অনুরণিত যে হচ্ছে না সে ব্যাপারে খুব একটা ভ্রুক্ষেপও নেই তার। লেক পেরুলেই ত্রিপুরা সুন্দরী কালী মায়ের মন্দির কিন্তু এইটুকুন পথও যেন আজ ফুরোচ্ছে না। এমন না যে কাপ্তাইয়ে এবারই প্রথম আসছে তনু। ছিমছাম কাপ্তাইয়ের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে যাবার সময় লেকের ধারে চা বাগানগুলো লাজুক মুখে যখন উঁকি দিত, প্রতিবারই যেন তনু সমরেশের সে স্বর্গছেঁড়া চা বাগানের গন্ধই যেন খুঁজে পাবার চেষ্টা করতো। কিন্তু আজকের কাপ্তাই লেক, লেকের পানিতে ভাসতে থাকা গোমড়ামুখো আকাশ সবাই যেন তনু মনে চলতে থাকা গোপন অভিমান-আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাস কান পেতে শুনে ফেলেছে! কাচের চশমা ঝাপসা হয়ে মুখখানা মনে পড়তেই ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে ওঠে তার। দায়সারাভাবে ভাবতে থাকে কী এমন তাড়া, কী এমন অভিমান; কী-বা এমন কষ্ট ছিল যে একবুক না বলা কথা বুকে চেপে চলে যেতে হলো! একটাবারও কি ভাবলো না দ্বীপজয়ের কথা। সারাক্ষণ গায়ে পিছে লেপ্টে থাকা ছেলেটা কীভাবেই বা বয়ে নেবে এ শোক! বয়সই বা হবে কত ছেলেটার- বছর দশেক! কীভাবেই বা পূরণ করবে ধূলোমাটির পৃথিবীর জটিল-কঠিন শূন্যতা আর বাস্তবতার সমীকরণ।
দ্বীপজয় মাকে হারিয়েছে মাস সাতেক হবে, সম্পর্কে তনুর বড়বোনের একমাত্র ছেলে। মায়ের ওপর দ্বীপজয়েরও অভিমান কম নয় বৈকি, জীবদ্দশায় কখনোই স্বীকার করতো না দ্বীপজয়ই তার একমাত্র সন্তান! কারণ ছোটবোনের পরিচয় ছাপিয়ে তনুকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো তার মা।
মাসকয়েক পরেই দূর্গাপুজো, আর পুজো মানেই বড়বোনকে নিয়ে শপিংমলে ইতিউতি ঘোরাফেরা। অষ্টমীতে শাড়ি না থ্রিপিস পরবে, শাড়ির পরলে তার সাথে কাঁচের চুড়ি না মেটালিক ব্রাসের চুড়ি-সব ঠিক করে দেয়ার দায়িত্বই যেন বর্তে যেত বড়দিদির ঘাড়ে। কিন্তু এবার….!!
এহেন অনিয়ত ভাবনা, প্রকৃতির বিশাল নির্মলতার মাঝে বড়দিদির শূন্যতা তনুকে মুহুর্মুহু আবেগঘন করে তুলছিল।
– ও আপা, নামবেন না নাকি?
পেছন থেকে নৌকার মাঝির ডাকে সম্বিত ফিরলো তনুর। মুখ গড়িয়ে চিবুকে হামাগুড়ি খাওয়া ভারী চোখের জল ওড়নার কোণে মুছতে মুছতে মন্দিরের পথ ধরলো সে।
আজকের এ দিনটাতেই জন্মেছিল তনুর বড়দিদি।
সরকারি চাকুরে বাবার চাকরিসূত্রে এ চন্দ্রঘোনার খ্রীস্টিয়ান মিশনারি হাসপাতালেই জন্ম হয়েছিল তনুর বড়বোনের। এ অঞ্চলের ধূলোমাটি-বাতাসেই কেটেছে তার শৈশব। বড় দিদির মুখে এই চন্দ্রঘোনা-কাপ্তাই লেক, পেপার মিল-গুমাই বিলের গল্প শুনতে শুনতে এখানকার পথঘাট ভার্চুয়াল ম্যাপের মতোই চোখে ভাসতে থাকে তনুর।
গুমোট মেঘের আড়ালে আজকের সূর্যটা মুখ লুকিয়ে চুপচাপ থাকায়, বেলা যে কখন গড়িয়ে গেল তা বেমালুম ভুলেই বসেছে ! শেষ বিকেলের ফিরতি নৌকায় লেকখানা যে পেরুতে হবে তার। সারাদিন মুখ গুমড়ো করে থাকা আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি নামল। লেকের পানিতে বৃষ্টি ফোঁটার দস্যিপনা, বেখেয়ালি ভেসে যাওয়া কচুরিপানা দেখে উদাস মনে তনু ভাবতে থাকে-
‘খুব বেশি কিছু তো নয়, কচুরিপানার জীবন চেয়েছিলাম,
যাযাবর হয়ে ঘুরেফিরে থাকতাম জলজ ঢেউয়ের সংসারে।
খুব বড়জোর অবাধ্য বৃষ্টি ফোঁটা হয়ে-
শান্ত কদমের পথ চেয়ে কাটিয়ে দিতাম আজন্ম বর্ষার অপেক্ষায়।’
একজীবনে মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না, হয়ত এজন্যই মানুষ তার নিয়তির ওপর প্রভূত্ব করতে পারে না-তনু’র আক্ষেপের সব গল্প দীর্ঘশ্বাসে মিলায়, ফিরতে হয় ইট-পাথর আর কালো ধোঁয়ার নাগরিক জীবনে। নিয়তির সাপ লুডো খেলার জালে বারংবার যাযাবরের মতো জীবন বাঁক নেয় নতুন কোন বাঁকের খোঁজে।