যাওয়া হলো না নুহাশ পল্লী

১৩ নভেম্বর ছিল হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ড. ভুঁইয়া ইকবালের লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো। ১৯ জুলাই ২০১২ সালে মৃত্যুবরণ করেন এ বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও নির্দেশক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর স্মরণে চট্টগ্রামে নাগরিক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় একই বছরের ৩ অগাস্ট। সে উপলক্ষে প্রকাশিত সংকলনে ড. ইকবালের (প্রাক্তন অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়) এ লেখাটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, ড. ভুঁইয়া ইকবাল সুপ্রভাত বাংলাদেশের সঙ্গে সাহিত্য উপদেষ্টা হিসেবে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন ২২ জুলাই ২০২১।
তাঁর প্রতিও গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

 

ড. ভুইয়া ইকবাল »

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের আগেই তার অনেক গল্প শুনেছি আমার বন্ধু আনিস সাবেতের কাছে। সেটা ১৯৬৭-৬৮ সালের কথা। আনিস সলিমুল্লাহ হলে ১৯৬৬-৬৭ তে আমার কক্ষসঙ্গী ছিল। দ্বিতীয় বর্ষে সে চলে যায় নবনির্মিত মহসিন হলে। মহসিন হলে ১ম বর্ষে ১৯৬৭ তে ভর্তি হয়েছিল হুমায়ূন। হলেই তাদের ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরঙ্গতার সূচনা। আনিস একদিন আমাকে বলে যে রসায়নের ছাত্র হুমায়ূন একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখেছে, আমি যেন পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখি। আনিস আমাকে ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ বইয়ের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। আমি এক রাতের মধ্যেই পাণ্ডুলিপি পড়ে ফেলি এবং সম্পাদক ডক্টর ইব্রাহীমের সঙ্গে কথা না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’ মাসিকপত্রে ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি ছাপাই। আমি ছিলাম ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’র কার্যকরী সম্পাদক।
তখন বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রচনা বা প্রকাশের চল ছিল না। ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ তরুণ পাঠক-পাঠিকাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বই আকারেও প্রকাশ পায়। বইয়ের সূচনায় ছোট ভূমিকায় হুমায়ূন ‘বিজ্ঞান সাময়িকী’র ও আমার কথা উল্লেখ করেছিল। পরেও সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় তার নিয়মিত কলামেও বিজ্ঞান সাময়িকীতে ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ প্রকাশের এবং আমার কথা উল্লেখ করেছে।
আমার ধারণা, হুমায়ূনের প্রথম বই ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। তবে ১৯৭২-এ আহমদ ছফার উদ্যোগে ‘নন্দিত নরকে’ ছাপা হয়। প্রথম সংস্করণে ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন ড. আহমদ শরীফ। আনিস সাবেতই ওই ভূমিকা লিখিয়ে নেয়। আর ১৯৭৩-এ ছাপা হয় ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। বইটি বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রথম প্রকাশের কথা সে উল্লেখ করেছে গুলতেকিন এর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার সময়।
১৯৭৩-এর এপ্রিল পর্যন্ত আমি দৈনিক বাংলায় সাংবাদিকতা করেছি। ওই সময়ে আমার অনুরোধেআহমেদ হুমায়ূন ‘নন্দিত নরকের’ একটি রসগ্রাহী সমালোচনা প্রকাশ করেন দৈনিক বাংলায়। সেটি ছিল হুমায়ূন আহমদের বইয়ের প্রথম প্রকাশিত সমালোচনা। আহমেদ হুমায়ূন আমাকে বলেছিলেন, হুমায়ূন ওই সমালোচনার কথা মনে রেখেছিল এবং তাঁর অনুরোধে দৈনিক বাংলার দুঃসময়ে আশির দশকে তার একটি উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের জন্য দেয়। আশির দশকের গোড়ার দিকে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকালে একবার ঢাকায় এলে হুমায়ূন তার সদ্য প্রকাশিত একটি বই আমার হাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উপহার পাঠিয়েছিল। পরে তাঁদের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিন বছর আগে শেষবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ‘দখিন হাওয়া’য় তার ফ্ল্যাটে। সে খুব আপ্যায়ন করে এবং শাওনের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়। সেদিন সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ আড্ডা হয়। সে আড্ডায় যোগদেন মঈনুল আহসান সাবের। কথা হয়, একদিন আমি নুহাশ পল্লী দেখতে যাবো তার সঙ্গে। তা আর যাওয়া হয়নি। দীর্ঘ ৪৫ বছরে তার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে বাংলা একাডেমীতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। মাঝে মাঝে ফোনেও কথা হতো। একবার আমি আমাদের উভয়ের বন্ধু অকাল প্রয়াত আনিস সাবেতের স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের সংকল্প করি। হুমায়ূন লেখা দিতে রাজি হয় সাগ্রহে- কিন্তু পরে আর লেখার অভাবে বইটি বের করতে পারিনি।