সাঈদুল আরেফীন »
গতরাতেও ঝড় বৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সব। আজকেও আকাশের অবস্থাটা ভালো নেই। কেমন জানি গুমোট হয়ে আছে প্রকৃতি। সকালে মর্ণিংওয়াকটা না করলে ফ্রেশ লাগে না। পুরো নগরীটা যেন কেমন হয়ে গেছে। সেই আগের কাকডাকা ভোর নেই। ছিমছাম পরিবেশ, সুনসান নিরবতা সবকিছু হারিয়ে গেছে। জীবনের বিশ বিশটা বছর ইউরোপে কাটিয়ে এসে কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে সাফিনের। বউটাও কেমন যেন আচরণ করছে। ছেলেমেয়েগুলোরও অপরিচিত আচরণ বিদেশ বিঁভুইয়ে এতাদিন থাকার চেয়েও যন্ত্রণাদায়ক মনে হচ্ছে। অথচ প্রতিদিন বিদেশে থেকে অনলাইনে তাদের সাথে হোয়াট’স অ্যাপে সরাসরি কথা বলা। মন খুলে সব আবদার মেটানো। কোনকিছুই তো বাদ রাখেনি। যা হবে হোক। এইসব ভাবলে মনটা আরো বিষণ্ন হয়ে উঠবে এই চিন্তায় পাথরঘাটার বাসা থেকে ঝটপট ট্র্যাকস্যূট পরে দৌড়াতে থাকে পরীর পাহাড়ের দিকে।
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এবড়ো থেবড়ো পরীর পাহাড়ে ওঠে জগিং এ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পাহাড়ের বুক চিরে সুদৃশ্য কর্ণফুলী আর প্রিয় চট্টগ্রাম শহরের পুরনো স্মৃতিতে একনজর চোখ বুলিয়ে নিতে দেরি করে না বিন্দুমাত্র। কাছেই পুরনো বাংলাদেশ ব্যাংক সংলগ্ন প্রিয় মুসলিম হাইস্কুলের দিকে তাকিয়ে স্মৃতির আল্পনায় সতীর্থ বন্ধুদের স্মরণ করতে থাকে। আর মনে মনে আউড়াতে থাকে- হায়রে কতো সুখের সেই দিন ছিলো আমাদের। বন্ধুরা এক একেকজন নানা জায়গায় চলে গেছে। কেবল সাফিনই টাকার নেশায় বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলো। জগিং করতে করতে একসময় একটা বেঞ্চের পাশে বসতেই পেছন থেকে একটা কোমল হাতের স্পর্শে ফিরে তাকায়। আরে নাবিলা তুমি? অদ্ভুত চোখে হা করে কিছুক্ষণ নাবিলার দিকে তাকিয়ে থাকে সাফিন। হাওয়ায় ভাসছে লম্বা কালো চুল। সেই টানা চোখ, সুন্দর মুখশ্রী, চিকন নাক। টকটকে ফর্সা। অদ্ভূত এক সুন্দরী নারী সাফিনের সামনে দাঁড়ানো। ছিমচাম সাজে লাল হলুদ আর সবুজের কাজ করা থ্রিপিসে অসাধারণ এক সুন্দরী মেয়ে সাফিনকে ছুঁতেই প্রকৃতিতে যেনো কাঁপন উঠলো। কিছুক্ষণ হা করে অবাক দৃষ্টিতে সাফিন তাকিয়ে থাকে নাবিলার দিকে। বিশ^বিদ্যালয় জীবনের অনেক ঘটনা মুহূর্তেই সাফিনকে নিয়ে যায় স্মৃতির দূয়ারে। স্মৃতিকাতরতায় বেশিক্ষণ ডুবে থাকতে দেয়নি নাবিলা। সাফিনই বাধ্য হয় সম্ভিত ফিরে পেতে। নাবিলার চোখে চোখ রেখে পলক আর পড়ে না সাফিনের। অদ্ভূত এক চাহনি নিয়ে প্রশ্ন করে বসে,
-তুমি একা একা কার সাথে আসছো ?
– একা কেন আমিই তো এখানকার জেলা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট। তুমি আমাকে চিনতে পারলে কীভাবে ?
– তোমাকে চিনবো না মানে ? তুমি তো সেই আগের মতোই রয়ে গেছো। সেই মুখ চোখ চপল চেহারা। সবই তো এ্কই রকম অবস্থায় রয়ে গেছো।
-আরে না! তোমার ভুল হচ্ছে সাফিন। আমি অনেক বদলে গেছি। তোমাকে অনেক খুঁজেছি। তোমার অপেক্ষা করতে করতে অবশেষে—–। যাক সেসব কথা। তুমি অনেকদিন পরে তোমার চাটগাঁ শহরে কীভাবে ? কখন এলে তুমি এখানে?
-থাক আমারটাও থাক। এখন বেঁচে আছি জীবনটাকে আঁকড়ে ধরে। আজ এই সময়ে এসে মনে হচ্ছে জীবনের সবটাই আমার ভুল।
-কী যে বলো সাফিন! তোমার উজবুক সব কথা রাখো তো ? ভার্সিটিতে থিসিসটা জমা দিয়ে সেই যে ট্রেন ধরলে, তোমার টিকিটিও আর পাওয়া যায়নি। আচ্ছা সাফিন আমি কি জোর করে তোমাকে কিছু করতাম? তুমি এই ভেবে সেদিন যে পালিয়ে বেড়ালে আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াওনি।
– কী যে বলবো তোমাকে নাবিলা? আমি একরকম বদ্ধ পাগলের মতো বাসায় ফিরে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু করতে পারিনি..
-তার মানে?
– না থাক অনেক বছর তো হয়ে গেলো, শুনে আর কী হবে ?
– না আমাকে শুনতেই হবে সাফিন। না হলে আমার এতো বছরের অপেক্ষমাণ জীবনের সবটাই বৃথা হয়ে যাবে।
– তুমি কী আজকেই সব শুনে ফেলবে।
– হ্যা আজকেই শুনতে চাই।
– থাক আরেকদিন শোনো সেইসব। পরীর পাহাড়ে মুহূর্তেই যেনো এক পশলা বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া বয়ে যায়। প্রকৃতির বিরূপ খেয়াল আবার দু’জনকে থামিয়ে দেয়।
পরদিন সকাল সকালই এসে হাজির হয়ে যায় দু’জনই পরীর পাহাড়ে। দূর থেকে কর্ণফুলী নদীর হাওয়া এসে এলোমেলো মনের ভেতর চঞ্চলতা উশকে দিচ্ছিল নাবিলার মনেও। নাবিলা যেনো ভুলতেই পারছে না সেসব দিনের কথা। বিশ^বিদ্যালয় জারুলতলা, বিশ^বিদ্যালয়ের পশ্চিমে গভীর অরণ্যে ঝর্নার ভেতর দিয়ে ছুটে চলার সেইসব স্মৃতিময় দিনগুলো নাড়া দিয়ে যায়। কীভাবে সেসব ভুলতে পারে নাবিলা? এখনো একটা বিশাল ঢেউ উথাল পাথাল করে দিচ্ছিল বুকের মধ্যে। ওদিকে সাফিনের চোখে জল গড়িয়ে পড়ে নাবিলার গায়ে। নাবিলা চোখ মুছে দিতে দিতে সাফিন বলে ওঠে,
-কেমন করে আমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো? সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে বাবা যে এতো আয়োজন করে বসে আছে তা ভাবার সুযোগই দেয়নি। প্রথমবার বিদেশ পাড়ি জমাতে হলো ভিসার মেয়াদ ছিলো মাত্র দু’দিন। তোমাকে বলে যাবো সে সুযোগটাও হয়নি আমার।
– জানো সাফিন আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি। তোমাদের শহরের বাড়ি, আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কেউ সঠিকভাবে বলতে পারলো না। শুধু মনকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে এতোটা বছর কাটিয়ে দিলাম তোমার আশায়। যাও আজ তোমাকে পেলাম অন্যভাবে। সত্যিই আমার জীবনটা লণ্ডভন্ড হয়ে গেলো। মিথ্যে আশায় পোস্টিং টা ও অনেক কষ্ট করে এখানে রেখেছিলাম।
-মানে?
-হ্যাঁ তুমি ঠিকই বুঝেছো- তোমারই আশায়, একমাত্র তোমারই আশায় পথ চেয়ছিলোম। আজ এতো বছর পরে কী দেখলাম, আর কী শুনলাম। তুমি সত্যিই পারলে সাফিন!
-কী বলো তুমি? আমি নই, আমাকে দিয়ে পুরোদস্তর জীবন নাটকের অন্যতম একটা জলছবি মঞ্চায়িত হয়ে চলেছে। বাধ্য হয়ে আমাকে সংসারী হতে হলো। তাও মনের মতো কিছুই হয়নি। ছেলেমেয়েগুলোও উচ্ছ্ন্নে গেছে। জীবনটাকে আমার বিষধর একটা সাপের মতোই মনে হয়। এর চাইতে তোমাকে আমাকে ঘিরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা ঢের ভালো ছিলো। চলো না আবার তুমি আমি আবার সেখানে ফিরে যাই!
-চাইলেই কী সম্ভব সাফিন? এটা বলে দুজনই সজোরে হাত চেপে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। এরপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে—
ওটাই ছিলো নাবিলা সাফিনের শেষ দেখা। তবুও নাবিলা তার কর্মব্যস্ততার পরিধি অনেক বাড়িয়ে রাখে। সরকারের নানা মন্ত্রণালয়ে ঘুরপাক করতে থাকে তার জীবন। সাফিন নিজের জীবনটার সাথে জড়াতে পারেনি নাবিলাকে। আবারও বিদেশ বিভূইয়ে পাড়ি জমায়। চাইলেও পারেনি নাবিলাকে নিজের মতো করে পেতে।
নাবিলা সাফিন নিজেদের অব্যক্ত স্মৃতিকাতরতার মধ্যে বেশ কিছুটা সময় পার করে দেয়। সাফিনের স্মৃতি বয়ে নিয়ে একাকী নাবিলা নিঃসঙ্গতার প্রতিচ্ছবিতে ভেসে বেড়ায় দেশের নানা প্রান্তে। সাফিন সেই যে নাবিলার সাথে শেষ দেখা। আর দেশে ফেরার কথা ভাবেনি কোন কালে। দূর থেকে পরিবার পরিজনের ভরণপোষনের নামমাত্র দায়িত্বটুকু পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। মানুষ কী চায়, কী পায়, বেদনা ও ভালোবাসার রঙিন পৃথিবীতে? একাকীত্ব যন্ত্রণায় ফেরারী মনটাকে সঙ্গী করে নেয় দুজনই । প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দুজন আলাদা থেকেও নিরবে নিভৃতে মানসিক সুখটাকে নিজের করে নেয়। প্রতি বছর বিশেষ দিনগুলোতে উপহার দেয়া নেয়া। প্রতিদিন কথোপকথনের মাধ্যমে না পাওয়া পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় করে নেয়। নিজেদের আপনাত্মায় একাকার হয়ে থাকার ভাবনাগুলো নাবিলা সাফিন ঘুনাক্ষরেও কাউকে জানতে দিতো না । কাক পক্ষীও টের পেতো না তাদের এই ভালোবাসার বন্ধন।
এভাবেই দিন যাচ্ছে আর বয়সের ভারে নিজেদের স্মৃতির স্বপ্নালোকের ছায়ায় ভাসতে থাকে। নাবিলা বিয়েথা না করে দেশে থেকেও নিজেকে মনে করতে থাকে সাফিন তার সারাজীবনের সঙ্গী হয়েই থাকে । তবে একদিন সকালে মুখপঞ্জীতে ভেসে ওঠা এক দুঃসংবাদে নাবিলা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। দুর্ঘটনা কবলিত সাফিনের রক্তাক্ত দেহ দেখে মোবাইলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাজ্যের প্রশ্ন নিয়ে। অন্যদিকে বালিশে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে সারাজীবনের পাহাড় সমান যন্ত্রণায়। বাংলোর গৃহপরিচারিকা এ দৃশ্য দেখে চীৎকার দিয়ে ওঠে আমাগো ডিসি ম্যাডাম আর নাই। এখানেই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব চুকে যায় অদৃশ্য পটে।