যতটুকু ভুল হয়েছিল

জোবায়ের রাজু »

আগামীকাল যেহেতু জয়ের জন্মদিন, এই নিয়ে প্রীতির মধ্যে একধরনের উদাসীনতা শুরু হয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষের জন্মদিন বলে কথা। বেশি কিছু না হোক, অন্তত একটা টি-শার্ট তো দেওয়া দরকার। দরকার হবেই বা না কেন! জয়কে সে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। যেখানে একটি ছেলে একটি মেয়ের মন পেতে যুদ্ধের মতো সাধনা করে যায় দিনের পর দিন, সেখানে প্রীতি নিজেই প্রপোজাল দিয়ে জয়কে নিজের করে নিয়েছে অনেকটা কৌশলে। এর আগে প্রীতির চোখে বাংলাদেশের কোনো ছেলেই সুপুরুষ হিসেবে গণ্য হয়নি। জয়ের মধ্যে অলৌকিক কিছু নেই হয়ত, কিন্তু প্রীতির চোখে জয় হচ্ছে অনন্য এক নওজোয়ান। চলনে বলনে, আচরণে, প্রথাগত মুখের টোল পড়া হাসি থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ানদের মতো নজর ফেরানো যায় না টাইপের মায়াময় চোখ, সবকিছু প্রীতিকে নিদারুণ এক চঞ্চলতার আবেগ উন্মাদনায় বুঁদ করে রাখত।
প্রথমে তো জয়ের কাছে পাত্তাই পায়নি প্রীতি, তবুও এ একধরনের তিরস্কার গায়ে মাখেনি স্বপ্নচারিনী প্রীতি। কারণ সে ততদিনে টের পেতে থাকে যে, জয় তার মনের পুরোটা অস্তিত্ব দখল করে ফেলেছে। তাই লাজ শরমের মাথা খেয়ে একদিন মনের কথা জানিয়ে দেয় জয়কে। বুক তার একটুও কাঁপেনি। কাঁপবেও বা কেন? যেখানে তার ভালোবাসার মধ্যে চুল পরিমাণও ভণিতা নেই, ন্যাকামি নেই, সেখানে তো আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠাটাই স্বাভাবিক। তাই জয়ের এক প্রকার অগ্রাহ্য অনুভূতি অনুমান করতে পেরে প্রীতি নিজেকে বারবার জয়ের প্রণয় কাঠগড়ার ভালোবাসার আসামী হয়ে গৌরবের সঙ্গে আত্মসমর্পণ করতে সাত-পাঁচ ভাবেনি। যতবার জয় সবিনয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে তৃষ্ণায় আধামরা হয়ে থাকা প্রীতিকে, ততবার প্রীতি নিজেকে ভালোবাসার রঙিলা ফুরফুরে প্রজাপতির মত রাঙিয়ে অনুরাগিনীর পাখা ঝাপটিয়েছে জয় নামের নিরন্তর বনমালীর কাছে। যেন সবকিছুর বিনিময়ে জয়কে তার চাই-ই চাই। কল্পনার মুক্তপথে ভালোবাসার উন্মুক্ত মিছিলে জয়ের বজ্রকন্ঠে অনুরাগের স্লোগান শোনার জন্য দু কান সজাগ রেখেছে প্রতিটি সেকেন্ডে।
এসব সাধনা অবশ্য প্রীতিকে বিফলে ফেলে দেয়নি, বরং ভালোবাসার জগতে জয় একদিন অতিথি পাখির মত উড়ে আসে প্রীতির নমনীয় আবেগের রাজ্যে। হাতে হাত রাখার গল্প শুরু হয় দুজনের। ভার্সিটির সবুজ ঘাসের গালিচায় বসে জয়ের কোলে মাথা রেখে আকাশের বলাকা দেখার সময়গুলো যেন বেঁধে রাখার জন্য ব্যাকুল চিত্ত আকুলতাতে ভরে উঠে প্রীতির। ‘ভালোবাসা’, চার অক্ষরের এই শব্দটির প্রতি সম্মান বাড়তে থাকে প্রীতির সমস্ত প্রকাশের ঈশারা-ইঙ্গিতে।
সেই জয়ের জন্মদিন আগামীকাল। কিন্তু একটা উপঢৌকন দেওয়ার জন্য প্রীতি মরিয়া হতে গিয়ে বুঝতে পারে তার কাছে উপযুক্ত পয়সা নেই। অন্তত একটি হাজার টাকা এই মুহূর্তে তার জন্য ভীষণ দরকার। তাই অভিলাষী প্রীতি তার বড় ভাই খোরশেদের মানিব্যাগ থেকে কৌশলে সরিয়ে ফেলল এক হাজার টাকার কচকচে নোটটি।
এরপরের ঘটনাগুলো অপ্রত্যাশিত। খোরশেদ তার মানিব্যাগের টাকাটার অস্তিত্ব না পেয়ে সন্দেহ করে বসে মারজাহানকে। চোখের ভারী বর্ষণ মুছতে মুছতে মারজাহান যতই বলে, ‘ভাইয়া, কসম। টাকাটা আমি চুরি করিনি’, খোরশেদের কাছে সেটা মারজাহানের নিছক মিথ্যা কথন হিসেবে বিবেচিত হয়। নির্দোষ মারজাহান খোরশেদকে যতই বোঝাতে চায় যে, এই অপকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত নয় সে, ততই বিদ্রোহী খোরশেদ বঙ্গোপসাগরের গর্জন কণ্ঠে ধারণ করে বলে, ‘এই বাড়ির সাধারণ একটা কাজের মেয়ে হয়ে চুরির স্পর্ধা কোথায় পেয়েছিস?’
দূর থেকে এসব নাটকীয় আলামত শুনে মাথা ব্যথা নেই প্রীতির। তার সমস্ত ভাবনা জুড়ে শুধু একটাই আয়োজন- জয়ের জন্মদিন। তাকে অন্তত একটা টি-শার্ট গিফট করার তাড়নায় প্রীতির মাথাটা কিলবিল করছে। টাকা হারানো রাগী খোরশেদ, মিথ্যা অপবাদের মারজাহানের অশ্রুত আকুতি, এসব কিছুর পাশ কাটিয়ে মুখে ভারী মেকাপের আস্তরণ মেখে প্রীতি হিল জুতায় ঠকঠক আওয়াজ তুলে ভার্সিটির নাম করে চলে গেল জয়ের জন্মদিনের জয়ধ্বনি করতে।
২.
শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরে আসে প্রীতি। এসে জানে টাকা চুরির অপরাধে মারজাহানকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। বুকটা ধক্ করে উঠে এই ঘটনার গোপন নাটের গুরু প্রীতির। বিনা কারণে মেয়েটাকে কাজ থেকে চাকরিচ্যুত করার অপরাধবোধ গোপনে হানা দিতে শুরু করে।
এই ঘটনা সাথে যে সে জড়িত, সেটা ঘরের কোনো প্রাণীকে বুঝতে না দেওয়ার অভিনয় করে বাথরুমে ফ্রেশ হতে ঢুকে গেল সে।
সন্ধ্যার পর বিছানায় শরীরটা হেলে দিতেই মেসেজ আসে জয়ের। জয় লিখেছে, জন্মদিনে এত সুন্দর টি-শার্টের জন্য কৃতজ্ঞতা। তবে আমার প্রতি তোমার এই আগ্রহের ব্যাপারে এখন কিছু কথা বলি। আমাদের পথচলা এখানেই থমকে যাক। সামনের মাসে সুমাইয়ার সাথে আমার বিয়ে। পারিবারিক সিদ্ধান্তে অনেক আগে থেকে এই বিয়ে পাকাপাকি হয়ে আছে। আমাদের সম্পর্কের মোড় এভাবেই ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দেওয়ার পর আমাদের দুজনার দুই পথ আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো হবে।
মাথাতে যেন বাজ পড়ে প্রীতির। জয় ঠাট্টা করছে না তো! সেটা জানতে ফোন দেয়। ওপার থেকে জয় জানায় তার মেসেজের কোনো বাক্য অলীক নয়। অতি শীঘ্রই তার বিয়ের বাজনা বাজবে।
চোখ ভিজতে থাকে ক্রমশ। প্রীতি সেটা আড়াল করতে গিয়ে খোরশেদের চোখে ধরা পড়ে। খোরশেদ বলল, ‘ওই কাজের মেয়েটাকে বের করে দিলাম বলে কাঁদছিস? কত বড় সাহস, আমার টাকা চুরি করে!’
ভাইয়ের কথায় কোনো ভাবান্তর হয় না ক্রন্দসী প্রীতির। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভালোবাসার সুবিশাল কুরুক্ষেত্রে প্রেম প্রেম সমরে জয় তাকে পরাজিত সৈনিক বানিয়ে দিয়েছে। এই অবিচার মেনে নেওয়া তো এত সোজা না।