ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন রক্ত, ফুসফুস, ব্রেইনসহ বিভিন্ন কোষের ক্ষতি করে :
সালাহ উদ্দিন সায়েম:
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে মেডিক্যাল অক্সিজেনের নামে বিক্রি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সিলিন্ডার। শিল্পকারখানার এ অক্সিজেন ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ঝালাইয়ের কাজে। কিন্তু এটি মেডিক্যাল অক্সিজেন নামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
দুই অক্সিজেনের পার্থক্য হলো কেবল পরিশোধন বিশুদ্ধতায়। কিন্তু বাজারে বিক্রি হওয়া ধাতব লোহার তৈরি সাদা-কালো রঙয়ের পাত্রের সিলিন্ডারের চেহারা দেখে মানুষের পক্ষে বুঝার কোনো উপায় নেই এটা কি মেডিক্যাল নাকি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন!
মেডিক্যাল ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের তফাৎ
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আব্দুল হান্নান জানান, মেডিক্যাল ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের উৎপাদন ও পরিশোধন পদ্ধতি ভিন্ন। মেডিক্যাল অক্সিজেন পরিশোধনে বিশুদ্ধতার মাত্রা থাকে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশের উপরে। ০.৫ শতাংশের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও পানির মিশ্রণ থাকে। আর ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন পরিশোধনে বিশুদ্ধতার মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে থাকে। এই অক্সিজেনের সাথে বায়ুম-লের অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণের মাত্রা থাকে বেশি।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, মেডিক্যাল অক্সিজেনের মধ্যে কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও পানির মিশ্রণের মাত্রা একেবারে কম বিধায় তা শরীরের জন্য সহনীয়। কিন্তু ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের বিশুদ্ধতার মাত্রা অনেক কম থাকে। এতে বায়ুম-লের অন্যান্য গ্যাসের মাত্রার পরিমাণ বেশি থাকে বিধায় তা শরীরের জন্য অসহনীয়। এসব গ্যাস শরীরের রক্ত, ফুসফুস ও ব্রেইনসহ বিভিন্ন কোষকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।
চট্টগ্রামে অক্সিজেন বাজারজাত করেন যারা
দেশে সরকার অনুমোদিত মেডিক্যাল অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে চারটি। এগুলো হলো, লিন্ডে বাংলাদেশ, স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্যাস লিমিটেড ও ইসলাম অক্সিজেন প্রাইভেট লিমিটেড। লিন্ডে ও স্পেকট্রার চট্টগ্রামে ডিপো ও প্ল্যান্ট রয়েছে। স্পেকট্রার ডিপো রয়েছে কালুরঘাট এলাকায়। আর সাগরিকা এলাকায় ডিপো ও কুমিরায় প্লান্ট রয়েছে লিন্ডের।
লিন্ডে ও স্পেকট্রার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দুটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে মেডিক্যাল অক্সিজেন বাজারজাত করে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুটি প্রতিষ্ঠান কেবল সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। এছাড়া কোনো রোগীর প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র সাপেক্ষে মেডিক্যাল অক্সিজেন সরবরাহ করে।
স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের চট্টগ্রামের ডিপো ইনচার্জ মো. আনিসুজ্জামান খান বলেন, বাজারের প্রতিষ্ঠানগুলো সিলিন্ডার নিয়ে কারসাজি করে বিধায় আমরা মেডিক্যাল অক্সিজেন এখন বাজারজাত করি না। তারা আমাদের প্রতিষ্ঠানের মোড়ক ব্যবহার করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বিক্রি করে। তবে আমরা রোগীদের কাছে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেখে মেডিক্যাল অক্সিজেন সরবরাহ করি।
বিক্রি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন
জানা গেছে, মেডিক্যাল সিলিন্ডার বাজারজাতের অনুমোদন দিয়ে থাকে ওষুধ প্রশাসন। কিন্তু চট্টগ্রামে ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদিত অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয়কারী কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। লিন্ডে ও স্পেকট্রা এখন নগরীতে মেডিক্যাল অক্সিজেন বাজারজাত করছে না। তাহলে কি বাজারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বিক্রি হচ্ছে?
দুই সপ্তাহ আগে নগরীর পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব প্রতিষ্ঠান মেডিক্যাল অক্সিজেন বাজারজাতের কোনো ডকুমেন্ট দেখাতে পারেনি ভ্রাম্যমাণ আদালতকে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক বলেন, বাজারে এখন যেসব অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে তা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন। ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে এসব সিলিন্ডার বিক্রি করছে। তারা কীভাবে এসব সিলিন্ডার বাজারজাত করছে সে সম্পর্কে আমাদেরকে কোনো তথ্য দিচ্ছে না। এসব সিলিন্ডার দেখে উপায় নেই যে, এর ভেতরে কি মেডিক্যাল নাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন রয়েছে।
চট্টগ্রাম ওষুধ প্রশাসনের সহকারী পরিচালক হোসাইন মোহাম্মদ ইমরান বলেন, মেডিক্যাল সিলিন্ডার বিক্রি করতে হলে ড্রাগ লাইসেন্স লাগবে। কারণ এটাও একটা ওষুধ। কিন্তু নগরীতে যেসব প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে তাদের কারো ড্রাগ লাইসেন্স নেই।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসন নগরীতে অনুসন্ধান চালিয়ে অনুমোদনহীন ৪০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে ভ্রাম্যমান আদালত।
মেডিক্যাল সিলিন্ডার চেনার উপায়
স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেডের চট্টগ্রামের ডিপো ইনচার্জ আনিসুজ্জামান খান বলেন, মেডিক্যাল সিলিন্ডারের গায়ে একটা স্টিকার থাকে। যেখানে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ড্রাগ লাইসেন্স নম্বর ও উৎপাদনের তারিখ লেখা থাকবে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিলিন্ডারের স্টিকারে ড্রাগ লাইসেন্স নম্বর লেখা থাকে না। কেবল এই একটি উপায়ে মেডিক্যাল সিলিন্ডার শনাক্ত করা যায়।
কীভাবে ও কেন কারসাজি
নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকায় অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করা একটি প্রতিষ্ঠানের এক বিক্রয় কর্মীর সাথে কথা হয় সুপ্রভাতের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিক্রয় কর্মী জানান, জাহাজে ব্যবহৃত কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ও আর্গন গ্যাসের খালি সিলিন্ডার পরিষ্কার ও রঙ পরিবর্তন করে সেখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন ভর্তি করা হয়। এরপর সিলিন্ডারের মুখ স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো হয়। এরপর তা বাজারজাত করা হয়। নগরীর বিভিন্ন শিল্পকারখানা থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সংগ্রহ করা হয় বলে জানান ওই বিক্রয় কর্মী।
জানা গেছে, অধিক মুনাফার আশায় নগরীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কারসাজি করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন বিক্রি করে থাকে।
অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি ঘনমিটার (১ ঘনমিটার সমান ১ হাজার লিটার) মেডিক্যাল অক্সিজেনের মূল্য হলো ৫২-৫৫ টাকা। আর ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের মূল্য হলো তার অর্ধেক, প্রতি ঘনমিটার ২০-২৫ টাকা। মেডিক্যালের চেয়ে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনে লাভ বেশি বিধায় ব্যবসায়ীরা এটা কারসাজির মাধ্যমে বাজারজাত করে বিক্রি করছে।
দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম বেড়ে যায় অক্সিজেন সিলিন্ডারের। করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে ১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটার (১ হাজার ৪০০ লিটার) অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম ছিল ৫-৬ হাজার টাকা। করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকলে তা এক লাফে বেড়ে ২০-২৫ হাজার হয়ে যায়। জুন মাসের শুরু থেকে বাজারে সিলিন্ডার সংকট দেখা দেওয়ায় এর দাম বাড়তে বাড়তে এখন ৪০ হাজার টাকায় এসে ঠেকেছে।