হুমাইরা তাজরিন »
সময়টা ১৯৭১ সালের ১৩ মে। ভোরবেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল বাড়ির উঠোনে এসে উপস্থিত হয়। তিন সন্তানকে নিয়ে নিজ ঘরে আটকা পড়েন রমা চৌধুরী। বাকিদের রেখে রমাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের ঘরে বন্দি করে পাকিরা।
জানালার একপাশে নিরূপায় সন্তানদের আর্তনাদ, অন্যপাশে অমানবিক নির্যাতন। এতেও ক্ষান্ত হয়নি অত্যাচারীর দল। এবার গানপাউডার ঢেলে পৈশাচিক অত্যাচারের প্রমাণ নিশ্চিহ্ন করা চাই। জ্বালিয়ে দেওয়া হলো ঘরবাড়ির সমস্তটা। সন্তানদের মুখ চেয়ে অপরাজেয় রমা আগুনের মধ্য থেকে নিজেকে টেনে নিয়ে ঝাঁপ দিলেন পুকুরে। এত বড় দুর্যোগের পরও রমার জীবনের দুর্দশার যেন সবে শুরু হলো। তারপর যতদিন বেঁচেছিলেন, দুর্যোগ যেন তাঁর পিছু ছাড়েনি।
আজ সেই বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৮ সালের আজকের দিনে (৩ সেপ্টেম্বর) তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
১৯৪১ সালের ১৪ অক্টোবর বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রমা চৌধুরী। ১৯৫২ সালে কানুনগোপাড়া মুক্তকেশী বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৬ সালে কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্লাতক পাস করেন রমা। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্লাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনিই দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রথম স্লাতকোত্তর ডিগ্রিধারী নারী ছিলেন।
বীরঙ্গনা রমার বিশেষ সাধ ছিল, সুযোগ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়ালেখা করার। কিন্তু সর্বস্ব হারানো বীরঙ্গনার কি-ইবা চাইবার থাকে এ জীবনে। তবু রাষ্ট্রের কাছে এটুকুই তাঁর শেষ চাওয়া ছিল।
জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বামী নৃপেণ চক্রবর্তী রমাকে ছেড়ে ভারতে পালিয়ে বাঁচেন। যুদ্ধের পর যখন ফিরে আসেন নৃপেণ, জানতে পারেন সম্ভ্রম হারিয়েছেন রমা। আজন্মলালিত সংস্কারের বশবর্তী হয়ে ব্রাহ্মণ সন্তান ডা. নৃপেণ চক্রবর্তী সাফ জানিয়ে দেন, ‘তুমি সম্ভ্রম হারিয়েছো, তোমার সাথে আমার আর সংসার করা হবে না রমা’। হিন্দু সামাজিক বিধানের বাধ্যবাধ্যবাধকতায় এ কথা মেনে নিতে হলো রমাকে। তিন সন্তানের জননী তিনি, চাইলেও আত্মহত্যা করার অনুমতিও বিধাতা তাঁকে দেননি।
পৈশাচিক নির্যাতন-পরবর্তী মানসিক ও শারীরিক ধকল সামলে পোড়াভিটেতে রমার তিন সন্তানকে লালনপালন অসাধ্য ঠেকছিল। খাদ্যবস্ত্রহীন হয়ে পোড়াজমিতে মাটি আঁকড়ে বেশিদিন বাঁচল না বড় সন্তান সাগর। নিউমোনিয়ায় তাঁর মৃত্যু হলো। এরপর দ্বিতীয় সন্তান টগরও মারা যায়। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে চতুর্থ সন্তান দীপংকর টুনু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। তারপর আমৃত্যু খালি পায়ে থেকেছেন। যে মাটিতে তাঁর আদরের সন্তানেরা শুয়ে আছে সেই মাটির ওপর জুতো পরে তিনি হাঁটতে পারেন না। এভাবে জীবনের চলার পথে বারংবার মর্মভেদী আঘাতের প্রতিঘাতগুলো একাই সয়েছেন। ১৬ বছর বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয়ে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর লেখালেখিকে তিনি জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন। যুদ্ধকালীন সেই নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন তাঁর লেখা ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে। এছাড়াও রচনা করেন গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাসসহ মোট ১৭টি বই। শহরে সেসব ফেরি করেছেন নিজেই।
২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের আমন্ত্রণ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখান করেন রমা চৌধুরী। পরবর্তীকালে শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধে ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই গণভবনে কোনো সাহায্য গ্রহণ না করার শর্তে রমা তাঁর সহকারী প্রকাশক আলাউদ্দিন খোকনসহ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান।
এই মরণপণ সংগ্রামের পেছনে তাঁর ভেতরে ছিল গভীর অভিমান, যা হয়তো একজন সম্ভ্রমহারানো নারীই জানেন। এ ঠিক যে কারণে যুদ্ধে পরাজয়ের আঁচ করতে পেরে রাজপুত নারীরা ‘জহরব্রত’ বা গণআত্মহত্যাকে বেছে নিতেন। অর্থাৎ পরাজয়ও হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু সম্ভ্রমহারানো নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটেছে। যার ফলে আমার জীবনে নেমে এসেছে শোচনীয় পরিণতি। আমার আশা-আকাক্সক্ষার জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম। আমার কাঁধে ঝোলা, খালি পা ও দুঃসহ একাকিত্ত্ব একাত্তরেরই অবদান।’
এবার সেই অভিমানী রমার স্বীকৃতি চান তাঁর বন্ধু আলাউদ্দিন খোকন। তিনি বলেন, ‘ওনার মতো মানুষ আমি দেখিনি। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য পর্যন্ত বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর ৫ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তাঁর এই আত্মত্যাগের স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর নাম সরকারি গ্যাজেটভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি। তাঁর সন্তান জওহরলাল চক্রবর্তী বেঁচে আছেন। তাঁরা যেন রমার চৌধুরীর প্রাপ্য সম্মানের ভাগিদার হতে পারেন সে ব্যবস্থা হোক। রমার সমাধি বাঁধাই হোক। পোড়াভিটেটা সংরক্ষণ করা হোক। সেখানে রমার স্বপ্নের অনাথালয় গড়ে উঠুক।’
রমা চৌধুরীর তৃতীয় সন্তান জহরলাল চৌধুরী বলেন, ‘আমার জন্ম ১৯৭০ সালের ২১ জুলাই। আমার মায়ের সংগ্রামের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী আমি। সন্তান হিসেবে আমি চাই, রাষ্ট্র আমার মায়ের নাম সরকারি গ্যাজেটভুক্ত করে তাঁর প্রাপ্য সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করুক। তাঁর স্মৃতিচিহ্ন পোড়াভিটেটা সংরক্ষণ করুক।’