সুভাষ দে »
গত এক বছরে কোভিড-১৯ এর মোকাবেলায় সম্মুখ যুদ্ধের সারিতে থেকে যাঁরা আত্মদান করেছে, এখনও মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে মানবতার সেবায় যাঁরা নিজেদের নিবেদন করে চলেছেন, তাঁদের আমরা যেন ভুলে না যাই। এদের মধ্যে প্রথমে রয়েছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী, রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক ও নানা পর্যায়ের গণমাধ্যমকর্মী, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। এছাড়াও করোনা মোকাবেলায় এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, ছাত্র যুব কর্মী, স্বেচ্ছাসেবী নানা সংস্থা-সংগঠন, এনজিও প্রতিষ্ঠানের সদস্য সদস্যা; ত্রাণ সাহায্য, ঔষধ সামগ্রী, সরঞ্জামাদি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, সরকারি ও বেসরকারি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় করোনা মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্যের কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
করোনা সংক্রমণের প্রথম কয়েক মাস দেশে ভয়াবহ অবস্থা ছিলো। দুই মাসেরও বেশি লকডাউন ছিলো, চারিদিকে ছিলো ভীতিকর অবস্থা। একে তো নতুন ভাইরাস অচেনা, প্রতিষেধক ও নেই, কিছু স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা, দোকানপাট বন্ধ থেকেছে। পরিবারের যে সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। জীবন ঝুঁকি জেনেও চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরাও সেই ভয়াবহ সময়ে মানবতার সেবায় সঁপে দিয়েছেন। তাঁদের নিরাপত্তা সরঞ্জামও অপ্রতুল ছিলো। কাছের মানুষগুলি যখন করোনা আক্রান্ত স্বজনকে ছেড়ে যান, তখন চিকিৎসকরাই থাকেন পাশে। তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। করোনায় প্রথম মৃত্যুবরণ করেন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মঈনউদ্দিন আহমদ (৪৭), গত বছরের ১৫ এপ্রিল। গত বছর থেকে এ বছর এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১৪৫ জন চিকিৎসক, বিএমএর তথ্য বলছে, এ পর্যন্ত ২ হাজার ৯১১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ২ হাজার নার্স এবং ৩ হাজার ২৯১ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। (সূত্র : প্রথম আলো ১৬ ও ২৩ এপ্রিল’২০২১)
চিকিৎসকের পর বেশি মারা গেছেন পুলিশ সদস্য। এ বছরের এপ্রিল এর মাঝামাঝি পর্যন্ত পুলিশ সদস্য মারা গেছেন ৯০ জন, এর মধ্যে ৬ জন র্যাব সদস্য। পুলিশ সদর দফতর এর তথ্য অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীতে আক্রান্ত হন ২০ হাজার ২৯১ জন। আক্রান্ত র্যাব সদস্য ২ হাজার ৬২৯ জন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণ লকডাউনের সময় কর্মনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন। গাড়ি চলাচল রোধ, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, দুস্থ ও অসহায়দের ত্রাণ পৌঁছে দেয়া, অসুস্থদের হাসপাতালে ভর্তি করানো, এসব মানবিক দায়িত্ব পালনে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা সক্রিয় ছিলেন। ৯৯৯ তে ফোন করলে পুলিশ ছুটে গেছে ঘটনাস্থলে কিংবা কোনো বাড়িতে ত্রাণ সাহায্য নিয়ে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা গ্রাম, শহর বাড়ি বাড়ি ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন, প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছেন। বিডিআর সদস্যরাও ত্রাণ সাহায্য দিতে গ্রামেÑগঞ্জে বাড়িতে বাড়িতে ছুটে গেছেন।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও সাধারণভাবে সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনা প্রতিরোধে সম্মুখ সারিতে ছিলেন। সরকারের এ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণ, নীতি সহায়তা, সরকারের লকডাউন কর্মসূচি, ত্রাণ পুনর্বাসন, সাহায্য, করোনা মোকাবেলায় জনগণের করণীয়-প্রভাব এসবের পাশাপাশি অসহায়দের সহায়তাকল্পে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা খুবই সক্রিয় ছিলেন, তারা ত্রাণ নিয়ে উপজেলার বাড়িতে বাড়িতে ছুটে গিয়েছেন, হোম কোয়ারেন্টাইন তদারক করেছেন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে নিচের দিকের কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫ জন, এদের মধ্যে ১৪জন কর্মরত ছিলেন, এ ছাড়া আক্রান্ত হয়েছেন হাজার খানেক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। (সূত্র : প্রথম আলো প্রতিবেদন ১৬ এপ্রিল’২০২১)
গত ১ বছরে করোনা মোকাবেলার সংগ্রামে সামনের সারিতে ছিলেন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কর্মীরা। ঘটনাস্থল থেকেই তাঁদের রিপোর্ট করতে হয়। হাসপাতাল কিংবা জনসমাবেশ, মার্কেট প্লেস, পরিবহন স্টেশন কিংবা গ্রেভইয়ার্ড, ত্রাণ তৎপরতা কিংবা লকডাউন পরিস্থিতি সকল জায়গায় সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিলো অনিবার্য। জাতির এই দুঃসময়ে প্রতিদিন তারা খবর দিয়েছেন, সরকারের কর্মসূচি, প্রচার করেছেন। এ ভয়াবহ বিপদে জনগণের মনোবল বজায় রাখতে নানা উদ্দীপনামূলক খবর দিয়েছেন, দেশ বিদেশের করোনা পরিস্থিতি, টিকা আবিষ্কার, প্রতিরোধ সংগ্রামে থাকা দেশÑবিদেশের যোদ্ধাদের খবর দিয়েছেন। দিবারাত্র ছুটে বেরিয়েছেন তারা দেশের সর্বত্র। নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেননি। কর্তব্যকেই প্রধান ভেবেছেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৬ জন সাংবাদিক। করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১৪ জন, করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে আছেন কামাল লোহানী, মিজানুর রহমান, সংবাদ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মসিউর খান জানান, সংগঠনের অন্তত ৫০ জন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত, সবার জন্য হাসপাতাল পাওয়া যায়নি। (সূত্র : প্রথম আলো-১৬ এপ্রিল)
মানুষের দুঃসময় ও জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে যেসব মহৎ প্রাণ নিজেদের জীবন আর্ত ও পীড়িতদের সেবায় উৎসর্গ করেছেন তারা মানবতার বার্তাবাহক, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। করোনা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী এসব যোদ্ধাদের পরিবার যাতে সরকারি সাহায্য ও প্রণোদনায় পান তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। সরকার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনা দেয়ার কথা বলেছেন, এটি অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মেটানো কর্তব্য।
করোনাকালে আমরা সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হারিয়েছি, তাঁদের মৃত্যু আমাদের মননশীল ও সৃজনশীল জগতকে দরিদ্র করেছে। ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, চিত্র শিল্পী মুর্তজা বশির, মনসুরুল করিম, সৈয়দ আবুল মকসুদ, ইব্রাহিম খালেদ, শামসুজ্জামান খানসহ সাহিত্য, চিত্রকলা, সাংবাদিকতা, সংগীত ক্রীড়া চলচ্চিত্র জগত ও নানা পেশার খ্যাতিমান মানুষদের আমরা হারিয়েছি, জাতির এই বিশিষ্ট সন্তানদের মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁদের অনেকেই বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা, জনগণের বিভিন্ন আন্দোলনÑসংগ্রাম, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন। জাতির মানসভূমি ঊর্বর করেছেন, সাংস্কৃতিক চেতনা শানিত করেছেন তাঁরা। বেশ কজন সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
করোনাকালে দেশের ছাত্রÑতরুণ স্বেচ্ছাসেবী, খেলোয়াড়, অভিনয় শিল্পী, নানা পেশার মানুষ রাজনৈতিক কর্মী, মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা আর্তের সাহায্যে ছুটে গেছেন। তরুণ ট্যাক্সি চালক গ্রাম থেকে অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী মায়েদের চট্টগ্রাম নগরের হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। কয়েকটি সংগঠন করোনার এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে মৃতদের দাফন, সৎকার করেছে। নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর মকসুদুল আলম করোনায় মৃত হিন্দু ব্যবসায়ীর মুখাগ্নি করেছেন তাঁর স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে। এটি মানবিক বোধের এক মহৎ দৃষ্টান্ত। প্রতিবন্ধী বাদশা খান তার সামাজিক সুরক্ষা ভাতা ৩ হাজার টাকা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ত্রাণ তহবিলে দান করেছেন। ছাত্র-তরুণরা ত্রাণ, অর্থ সংগ্রহ করে লকডাউনে দুস্থ ও অসহায় মানুষদের যথাসম্ভব সাহায্য করেছে।
করোনার গ্রহণের কাল কবে অতিক্রান্ত হবে কেউ বলতে পারে না, একদিন হয়তো এই মহামারির অবসান হবে। করোনার সময়কাল অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, অর্থনৈতিকÑসামাজিক ক্ষেত্রে ভাঙচুর হচ্ছে, হবেও সামনে বৈষম্য আরও প্রকট হবে, মানুষ আরও অসহায় হবে, নিষ্ঠুর হবে তবে এর মধ্যদিয়েও মানবতা ও সামাজিক জাগরণের যে স্ফুরণ দেখা গেছে, তা অনির্বাণ রাখা এবং এর শিখা উজ্জ্বলতর করার দায়িত্ব নিতে হবে তরুণ ও সচেতন রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মীদের। গ্রামে, পাড়ায়, শহরের মহল্লায় মানুষের পাশে দাঁড়াবার স্বেচ্ছাব্রতে নিয়োজিত হতে হবে। তবেই মানুষ আশা-ভরসার জায়গা পাবে। করোনার সময়ে যারা সামনের সারিতে থেকে সেবা আর কর্তব্যনিষ্ঠার স্বাক্ষর রাখলেন, নিজেদের উৎসর্গ করলেন, তাদের জাতীয় স্বীকৃতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো রাষ্ট্রের, সমাজের কর্তব্য।
লেখক : সাংবাদিক