শহরের মধ্য দিয়ে এক দমকা বাতাস এসে আছড়ে পড়ল। সবকিছু যেন হঠাৎই বদলে যেতে শুরু করল। কেবল মানুষ নয়, সব কিছুÑগাছপালা, ঘরবাড়ি, মাটি, আকাশÑসবকিছুর ওপর চেপে বসেছে এক ধোঁয়াশা। বাতাসের প্রবাহে যেন ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে এক পরিচিত পৃথিবী। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, শহরের এক কোণে মাটির নিচ থেকে উত্থিত হলো এক অদ্ভুত দৃশ্যÑকবরের মধ্য থেকে উঠে আসছে মানুষ। তবে তারা মৃত নয়, যেন তারা ফিরে এসেছে অন্য কোনো এক জীবন থেকে। রাতের মধ্যভাগ। সরু রাস্তার ধারে ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসে কালো ধোঁয়া। ঘুম ভাঙে সুনীলের। সে খাট থেকে উঠে পায়ে চটিজোড়া গলিয়ে দরজার দিকে এগোয়। বাইরে তাকিয়ে সে দেখে, তার চারপাশে মানুষেরা নির্বিকার মুখে হাঁটছে, যেন সবকিছু আগের মতোই আছে, কিন্তু সুনীলের মনে হচ্ছে যেন এই মানুষগুলো আসল নয়। এদের মধ্যে পরিচিত কারও সঙ্গেও দেখা যায় না, অথচ এই রাস্তায় তো সে জন্ম থেকে বড় হয়েছে।
হঠাৎই তার মাথার ভেতর শোনা যায় এক কণ্ঠস্বর, যেন গভীর কোনো সমুদ্রের তলদেশ থেকে ভেসে আসছে, ‘তুমি কী দেখছো, সুনীল?’ সে উত্তর দেয় না, তার গলা শুকিয়ে এসেছে। সুনীল জানে না, সে কীভাবে এই অদ্ভুত দৃশ্যের মুখোমুখি হলো।
ধীরে ধীরে সে তার ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে, এবং দেখতে পায় যে চারপাশে মৃত মানুষগুলো ধীরে ধীরে মাটির ওপর উঠে দাঁড়াচ্ছে, তাদের চোখে অজানা বিস্ময়। প্রথমে সে ভাবে, এরা মৃত নয়Ñএরা কোনো এক ভিন্নতর বাস্তবতার বাসিন্দা। তারপর সে বুঝতে পারে, এরা আসলে সেই মানুষগুলো যারা জীবনের দীর্ঘদিন ধরে লুকিয়ে ছিল, আর আজ তাদের মুখোশ খুলে গিয়ে সত্যিকারের রূপে ফিরে এসেছে।
বাতাস ভারী হয়ে উঠছে, যেন পৃথিবীর আকাশ আরও কাছে নেমে এসেছে। সুনীল দেখছে, শহরের চারপাশের কাঠামোগুলো ভেঙে পড়ছেÑমানুষেরা তাদের পরিচিত জীবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে, এবং তাদের আত্মার গভীরতম স্বরূপ মাটির ওপরে প্রকাশিত হচ্ছে। এ এক অদ্ভুত উত্তরণ, যেন মৃত্যু থেকে নতুন জীবন।
এক বৃদ্ধা এসে তার দিকে তাকায়, তার ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি। ‘আমরা কি আবার ফিরে এসেছি?’ তার কণ্ঠস্বর যেন ছায়ার মতো ফিসফিস করছে। সুনীল কিছু বলার আগে বৃদ্ধাটি তার চোখ বন্ধ করে নেয়, এবং ধীরে ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তার শরীর এক ভিন্ন আকৃতিতে রূপান্তরিত হচ্ছেÑকখনো একটি গাছ, কখনো একটি পাখি, আবার কখনো মেঘের আকার ধারণ করছে। এ এক অসম্ভব মেটামরফোসিস, যেখানে মানুষ আর প্রাকৃতিক জগত একসঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
সুনীল বুঝতে পারছে না, এটা স্বপ্ন, না তার বাস্তবতা। শহরের মাঝখানে অদ্ভুত এক প্রান্তর তৈরি হয়েছে, যেখানে কেবল জন্ম ও পুনর্জন্মের আবর্ত চলছে। কেউ কেউ তাদের মৃত আত্মীয়কে দেখে চমকে ওঠে, আবার কেউ কেবল নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন অপেক্ষায় আছে, কখন তাদের পালা আসবে।
এ দৃশ্যের মধ্যে হঠাৎই একটি অদ্ভুত শব্দ আসেÑএটা যেন হাসির মতো, আবার কান্নার মতোও শোনায়। সুনীল চারদিকে তাকায়, কিন্তু সে কাউকে দেখতে পায় না। তারপর, আকাশের দিকে তাকালে দেখে, মেঘের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে এক বিশাল চিত্র ভেসে আসছেÑএটা এক পুতুলের মতো অবয়ব, তার হাতে ধরা এক বিরাট কাঁচি। সে যেন সবাইকে কেটে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, যেন তাদের বেঁচে থাকার নিয়মগুলোকে বদলে দিচ্ছে।
‘আমরা সবাই পুতুল,’ মাটির নিচ থেকে উঠে আসা এক কণ্ঠস্বর বলে। ‘আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু আমাদের আত্মা কখনো বাঁধা পড়ে না।’
সুনীল নিজের দিকে তাকায়, দেখে তার হাত দুটো আর মানুষের হাতের মতো নেই, যেন কোনো এক পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে। সে বুঝতে পারে, এই শহরের মানুষেরা আর কেউ নিজেদের মতো নেই, তারা সবাই যেন ভিন্ন কোনো বাস্তবতায় চলে গেছে। তার নিজের শরীরও ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। তার পায়ের নিচের মাটি ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠছে।
তখনই তার মনে পড়ে যায়, সে এভাবে জীবন কাটাতে চায়নি। তার মনে হয়, হয়তো এটাই তার মৃত্যুর দিন, কিন্তু এক অদ্ভুতভাবে সে উপলব্ধি করে, মৃত্যু আসলে উত্থানও হতে পারেÑএক নতুন রূপে ফিরে আসার একমাত্র পথ।
‘তুমি প্রস্তুত তো?’ বাতাসের মধ্য দিয়ে ভেসে আসে কণ্ঠস্বরটি। সুনীল চোখ বন্ধ করে, অনুভব করে তার আত্মা ধীরে ধীরে মাটির নিচে মিশে যাচ্ছে, আবার তা আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জীবন ও মৃত্যু এখানে মিশে গেছে একে অপরের সঙ্গে।
শহরের প্রতিটি মানুষ ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছে, এবং সুনীল যেন প্রতিটি ধাপে আরও গভীর কোনো অচেনা জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। চারপাশের মানুষের চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা, যেন তারা এখন আর মানুষ নয়, বরং ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনো স্মৃতির প্রতিচ্ছবি। তার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সে দেখে, ত্বক নেইÑশুধু হাড়ের ফাঁক দিয়ে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সে আলো থেকে ছায়া তৈরি হচ্ছে, আর সেই ছায়াগুলো ঘুরে ঘুরে আকাশে মিশে যাচ্ছে।
তখনই হঠাৎ শহরের আকাশ থেকে একটি বিশাল ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে মাটির দিকে নেমে আসতে শুরু করে। তার চোখে কোনো মুখ নেই, নেই কোনো শরীরের গঠন। শুধু এক ছায়াময় কুয়াশা যেন মাটির সঙ্গে লেগে আছে। কণ্ঠস্বরটা আবার শোনা যায়, এবার অনেক গভীর এবং থমথমে, ‘তুমি কি জানো, সুনীল, কারা ফিরে এসেছে?’ সে কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার গলার ভেতর যেন শতাব্দীর ধ্বংসস্তূপ জমাট বেঁধে আছে।
সেই মুহূর্তে আকাশ ফেটে বেরিয়ে আসে আরও কিছু মূর্তি, তারা ধীরে ধীরে শহরের ছাদে বসতে থাকেÑএরা কারা, সুনীল বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, এরা যেন এক অন্য জগতের যাত্রী, অথবা বহু আগে হারিয়ে যাওয়া কেউ, যারা এখন আবার ফিরে এসেছে। তাদের মুখ নেই, কেবল শরীরের চারপাশে ছড়িয়ে আছে কালো কুয়াশার মতো আবরণ। তারা সবাই স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, আর নিচ থেকে ওঠা মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তাদের আবার পুনর্জন্ম দিচ্ছে।
সুনীল বুঝতে পারে না, সে কোন বাস্তবতার মধ্যে আছেÑজীবন, মৃত্যু, নাকি তার চেয়েও গভীর কোনো শূন্যতা। হঠাৎ, এক অসম্ভব দৃশ্য চোখে পড়েÑতার নিজের শরীর ধীরে ধীরে বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোথাও যেন তার অস্তিত্বের ছায়া রয়ে গেছে। সবকিছু মিলেমিশে এক অদ্ভুত, রহস্যময় স্থবিরতায় থেমে থাকে।
তখনই, সবকিছু থেমে যাওয়ার মুহূর্তে, সে অনুভব করে এক প্রচণ্ড কাঁপুনি। তার চারপাশের সমস্ত মানুষ, যাদের সে মৃত ভাবছিল, হঠাৎ একসঙ্গে চোখ খুলে তার দিকে তাকায়। তাদের চোখে ভয়াবহ এক চেতনা, যেন পৃথিবীর সব রহস্য তারা জেনে গেছে। তারপর, তাদের মধ্যে কেউ একজন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে সুনীলের দিকে। সে মুখ তুলে বলে, ‘আমরা কেউ ফিরে আসিনি। তুমি আমাদের তৈরি করেছো।’
সুনীলের শরীর হিম হয়ে আসে। বাতাস যেন থেমে গেছে, শহরটাও স্তব্ধÑএক গভীর, নির্জন স্তব্ধতা। মানুষগুলো, যারা তার দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ করেই মাটি থেকে ভেঙে পড়তে থাকে। তাদের শরীর গলে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আর তাদের চোখে একধরনের শূন্যতাÑযেন তারা কিছু না জানার অভিশাপে বন্দি।
সুনীল পেছনে সরে আসে, কিন্তু তার পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেছে। আকাশে ঝুলে থাকা সেই ছায়ামূর্তিরা ধীরে ধীরে নেমে আসতে থাকে। তাদের মুখ অদৃশ্য, কিন্তু অদৃশ্য চোখ যেন তার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। হঠাৎ সুনীল অনুভব করে, তার চোখও যেন মুছে যাচ্ছেÑকোনো দৃষ্টি নেই, কোনো অনুভূতি নেই। শুধু তার চারপাশে এক গভীর ধোঁয়াশা। সে হাঁপাতে শুরু করে, কিন্তু বাতাস নেই।
মাটির নিচে থেকে আবার সেই কণ্ঠস্বর ফিসফিসিয়ে ওঠে, ‘তুমি আমাদের তৈরি করেছো, সুনীল। আমরা কখনোই ছিলাম না।’
তার ভেতর এক বিস্ময়কর শীতলতা নেমে আসে, যেন সমস্ত কিছুর অর্থ হারিয়ে গেছে। সুনীল নিজের হাতের দিকে তাকায়Ñতার হাত আর নেই, কেবল এক কুয়াশার ধোঁয়া। তার শরীর ধীরে ধীরে মাটি থেকে উড়ে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে, সে নিজেই আর নেইÑতার অস্তিত্ব ছিল এক কল্পনার ধোঁয়া, আর সেই ধোঁয়াই এখন তাকে গ্রাস করছে।
চারপাশের শহরটি এখন পুরোটাই কুয়াশার ভেতর বিলীন। কণ্ঠস্বরটি আরও গাঢ় হয়ে ওঠে, ‘তুমি ভাবছো, তুমি বেঁচে ছিলে। কিন্তু তুমি তো কেবল এক ছায়া, সুনীল। আমরা ছিলাম, তোমারই ছায়া।’
সুনীলের মস্তিষ্কের ভেতর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেতে থাকে বাস্তবতার সব ধারা। সে কেবল এক শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। তার চারপাশে আর কোনো মাটি নেই, শহর নেই, কিছু নেই। কেবল ধোঁয়ার মতো অস্পষ্ট এক শূন্যতা, যেখানে সে একমাত্র সত্তাÑকিন্তু সে নিজেই কে, তাও আর জানে না।
শেষে, ধীরে ধীরে, সমস্ত কিছু মিলিয়ে যায়, আর সুনীলের মনে হয়, সে কখনো ছিলই না। শুধু ধোঁয়াশার ভেতর এক অস্পষ্ট কল্পনা, যে তার নিজের অস্তিত্বের রহস্যে হারিয়ে গেছে।
ফিচার শিল্প-সাহিত্য