উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফীর নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াই আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন বেগম মুশতারী শফী। মৃত্যুশয্যায়ও তিনি একটি শপথনামা লিখে আহ্বান জানিয়ে গেছেন সেই লড়াই অব্যাহত রাখার। মুশতারী শফীর চেতনা ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নিলেই উনার প্রতি প্রকৃতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘বেগম মুশতারী শফী নাগরিক স্মরণসভা পরিষদের’ উদ্যোগে আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন।
প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি রাশেদ হাসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন উদীচী চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও গণজাগরণ মঞ্চ চট্টগ্রামের সদস্যসচিব ডা. চন্দন দাশ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, সিপিবি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি কানাইলাল দাশ, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, অধ্যাপিকা আনোয়ারা আলম ও ফেরদৌস আরা আলীম এবং প্রয়াত মুশতারী শফীর সন্তান ফারজানা নজরুল ও মেহরাজ তাহসান শফী।
কবি আবুল মোমেন বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফীর জীবন ত্যাগ ও সংগ্রামের জীবন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি স্বামী ও ভাইকে হারিয়েছেন। এরপরও দমে যাননি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছেন, নিজে সেখানে অংশ নিয়েছেন শব্দসৈনিক হিসেবে। ষাটের দশকে এদেশের পিছিয়ে থাকা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, গরীব পরিবারের নারীদের সংঘটিত করে তাদের অধিকার আদায়ে কাজ করেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি লেখালেখি করেছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন করেছেন। উনার সবচেয়ে বড় অবদান ঘাতক-দালালদের বিচারের আন্দোলন। সাহসী ভূমিকা নিয়ে তিনি এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।’
ডা. চন্দন দাশ বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফীর নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন করেছিলাম। এমনকি যখন গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হল, উনি এসে লাখো তরুণকে শপথবাক্য পাঠ করালেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে আপসের বিরুদ্ধে উনি বারবার গর্জে উঠেছেন। সংস্কৃতির সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গরিব-মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি উদীচীতে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। যে আদর্শের পতাকা তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন, আমরা সেটা আমৃত্যু বহন করে নিয়ে যাব।’
দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘মৃত্যুশয্যায় তিনি একটি শপথবাক্য লিখে রেখে গেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লড়াই-সংগ্রাম জারি রাখার কথা বলে গেছেন। আমরা যদি এ লড়াই জারি রাখতে পারি তাহলেই বেগম মুশতারী শফীকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।’
মফিজুর রহমান বলেন, ‘বেগম মুশতারী শফী সরাসরি রাজনীতি করেননি। কিন্তু তিনি জাতির সংকটকালে একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের সকল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
মুশতারী শফীর সন্তান মেহরাজ তাহসান শফী বলেন, ‘আমার মা সরাসরি রাজনীতি না করলেও বামধারায় প্রভাবিত ছিলেন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, মনেপ্রাণে ধারণ করতেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে আমার মা সারাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেছিলেন, তার ধারাবাহিকতায় আমরা কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার দেখতে পেয়েছি। বাহাত্তরের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল উনার স্বপ্ন। এজন্য তিনি লড়াই-সংগ্রাম করেছেন।’
স্মরণসভার শুরুতে সঙ্গীত পরিবেশন করে উদীচী চট্টগ্রাম ও রক্তকরবীর শিল্পীরা। শোক প্রস্তাব পাঠ করেন উদীচী চট্টগ্রামের সহ সাধারণ সম্পাদক জয় সেন। জীবনী পাঠ করেন আবৃত্তিশিল্পী সেলিম রেজা সাগর। বিজ্ঞপ্তি