শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি
সনেট দেব »
বাংলা নাট্যভুবনে এমন কিছু সৃষ্টি আছে, যা সময়কে অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে থাকে শুধু শিল্পমূল্যের জন্য নয়—মানসিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ধারায় অংশগ্রহণের জন্য। মুনীর চৌধুরীর কবর সেই ধরনের একটি নাট্যকীর্তি, যা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আজও বাঙালির চিন্তা ও চেতনায় অমোচনীয় ছাপ ফেলে চলেছে। আজ যখন আমরা তাঁর শততম জন্মদিনে জীবন ও সৃষ্টির দিকে ফিরে তাকাই, তখন স্পষ্ট হয়—কবর কেবল একটি নাটক নয়; এটি ভাষা, ইতিহাস ও জাতীয় পরিচয়ের নৈতিক বিবেক।
১৯৫২ সালে কারাবন্দী অবস্থায় মুনীর চৌধুরী যখন কবর রচনা করেন, তখন তাঁর সামনে ছিল না মঞ্চ, ছিল না আলো-ছায়ার যন্ত্রপাতি। তাঁর সামনে ছিল গুমোট সেলের দেয়াল, কিন্তু মনের ভেতর ছিল ভাষার জন্য মরতে যাওয়া তরুণদের অগ্নিময় মুখ, তাদের অদম্য বিশ্বাস, তাদের রক্তাক্ত শরীরের ওপর ভর করে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যৎ বাঙালি জাতিসত্তা। তাই নাটকে যে শোক, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের মিলন ধ্বনিত হয়েছে—তা নাট্যকারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জাতীয় ট্র্যাজেডির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এক শিল্পসত্য। কবর—নামের ভেতরেই বাঁধা আছে মৃত্যু ও স্মৃতির অদৃশ্য সমীকরণ। মৃত্যুকে মেনে নেয় না যারা, তারাই শেষ পর্যন্ত জীবনের দিশা দেখায়—নাটক এই সত্যকেই রূপকভাবে প্রতিষ্ঠা করে।
নাটকের প্রতিটি চরিত্র যেন একেকটি সময়ের প্রতীক। নেতা—যে ক্ষমতার লোভে মানুষের রক্তকেও ভুলে যেতে পারে; হাফিজ—যে ভীরুতার মুখোশের আড়ালে বাঁচতে চায়; আর মুর্দা ফকির—যে মৃতদেরও জীবন্ত করে তুলতে পারে তার ভবিষ্যদ্বাণীময় কণ্ঠে। বিশেষ করে মুর্দা ফকিরের উপস্থিতি নাটকে এক অসাধারণ ‘মেটাফিজিক্যাল’ শক্তির সৃষ্টি করে। তিনি জীবিত আবার মৃত—দুই-ই। মুর্দা ফকির- নাটকের সবচেয়ে অবাস্তব চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্রটিই নাটককে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এই রঙ্গিন চরিত্রটিই সর্বপ্রথম নেতা-হাফিজের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে। তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। মুর্দা ফকির একটু পাগল ধরনের মানুষ, যে কবরস্থানে থাকে। তার একটাই ভয়, মারা গেলে যদি কেউ তাকে কবর না দেয়! এজন্যই সে কবরস্থানে থাকে, যাতে মৃত্যুর সময় আসলে লাফ দিয়ে কবরে ঢুকে যেতে পারে। এই চরিত্রের মাধ্যমেই নাট্যকার বলার চেষ্টা করেন- ভাষা শহীদরা কেউ মরেনি, মরেছে তারা যারা রাতের আধারে শহীদদের লাশ গোপনে কবর দিয়েছে।
“মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়—কারণ অনেক সময়ই মানুষ অকারণে বদলায়” নাটক এই বদলে যাওয়া মানুষকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে। নাটকে যারা সত্যের পাশে দাঁড়াতে পারে না, যারা স্বার্থে বা ভয়েতে নিজেদের রূপ বদলায়, তারা জীবিত থেকেও নৈতিক মৃত্যুর দিকে এগোয়; আর যারা মৃত্যুকে বরণ করে আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখে, তারা “মৃত” হয়েও অমর হয়ে ওঠে। এখানে জীবিত মানুষের বদলে যাওয়া—যা অকারণেই হোক বা স্বার্থের কারণে—নাটকের পটভূমিতে এক ধরনের বিপরীত প্রতিচ্ছবি তৈরি করে। কারণ ‘কবর’ দেখায়, প্রকৃত বদল শরীরে নয়, চরিত্রে; প্রকৃত পচন দেহে নয়, বিবেকে। তাই শেষ পর্যন্ত এই কথাটি শুধু জৈবিক সত্য নয়—এটি একটি নৈতিক পর্যবেক্ষণও: মৃত্যু অপরিবর্তনীয়, কিন্তু জীবনের পরিবর্তন সবসময় মহৎ নয়; কখনো তা কেবল অকারণ ভাঙন, সময়ের সঙ্গে মানুষের নিজেরকেই হারিয়ে ফেলা।
মুনীর চৌধুরী কবর শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে এক অনন্য বাংলা রাজনৈতিক নাট্যরীতির মাইলফলক হিসেবে। সেখানে নেই দীর্ঘ সংলাপের বাহুল্য, নেই আবেগের অতিরঞ্জন। আছে তীক্ষ্ম, ধারালো, সংক্ষিপ্ত সংলাপ—যা ছুরির মতো কেটে যায় শাসকের অন্যায়, সমাজের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক প্রতারণাকে। নাটকের বর্ণনাশৈলী, দৃশ্য-পরিবর্তন, কোরাস ব্যবহার—সবকিছুতেই স্পষ্ট যে তিনি চাইছিলেন নাটককে সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। বাঙালি নাট্যমঞ্চে এ ছিল নতুন দিগন্তের সূচনা।
কবর-এর প্রভাব কেবল ৫০-এর দশক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রতিধ্বনি শোনা গেছে— ৬০’র দশকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আন্দোলনে, ৭০-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে, —স্বাধীনতা পরবর্তী নাট্যচর্চায়, এমনকি ডিজিটাল যুগের তরুণদের প্রতিবাদ-সংগীত ও মনোভাবেও। নাটকটি বাঙালির জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের ভিতকে দৃঢ় করেছে। প্রতিবার যখন এই নাটক মঞ্চস্থ হয়, নতুন প্রজন্ম নিজেদের ইতিহাস নতুন করে আবিষ্কার করে—শুধু ভাষার নয়, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামের ইতিহাসও।
মুনীর চৌধুরীর শততম জন্মবাষিকীতে তাঁর সৃষ্ট কবর-কে নতুন করে পড়া জরুরি। কারণ সময় বদলায়, শাসন বদলায়, নেতৃত্ব বদলায়—কিন্তু মুনীর চৌধুরী আমাদের শিখিয়েছেন যে ইতিহাস বদলায় না; বদলায় কেবল তার ব্যাখ্যা। আর সেই ব্যাখ্যা তৈরির দায়িত্ব প্রতিটি প্রজন্মের। আজও যখন সমাজে ভয়, অন্ধকার, অসহিষ্ণুতা, ভাষা ও সত্যের ওপর আঘাত আসে। মুনীর চৌধুরীর কবর তাই শুধু নাটকের নাম নয়—এটি স্মৃতির বিরুদ্ধে বিস্মৃতির লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিবেকের সংগ্রাম, এবং বাঙালির নতুন হয়ে ওঠার অদম্য শক্তি।




















































