এম এস ফরিদ :
অনীল দুরন্ত প্রকৃতির ছেলে। সারাদিন মাঠ-ঘাট, বনবাদাড় আর গাছতলায় ঘুরে বেড়ায়। পড়াশোনায় মনোযোগ নেই বললেই চলে। সকালে খেয়ে বের হলে ফিরে সূর্যাস্তের আগ মুহূর্তে। দুপুরে বিভিন্ন গাছের ফলফলাদি খেয়ে বেড়ায়। মাঝে-মাঝে বাড়িতে খেতে আসলেও চুপি-চুপি খেয়ে ফের বেরিয়ে পড়ে। ভরদুপুরে তপ্ত রোদে টইটই করে ঘুরে বেড়ানোই তার শখ। খেলাধূলায়ও বেশ মনোযোগী। ডাংগুলি, কাবাডি, কানামাছিসহ নানারকম খেলা তার খুবই প্রিয়। এছাড়াও তার আরো একটি প্রিয় শখ হলো খাঁচায় বন্দি করে পাখি পোষা। এজন্য অনীল বনবাদাড় আর গাছের তলায় ঘুরে-ঘুরে পাখির বাসা দেখে। হাতে থাকে পাখিশিকার করার গুলতি। গাছের ডাল দিয়ে নিজের হাতে তৈরি করা গুলতি বেশ মজবুত ও টেকসই। একবার তাক করে ছুঁড়লে পাখির গায়ে গিয়ে পড়েই। গুলতি মারতে-মারতে তার হাতও বেশ পাকা হয়ে গেছে। অনীল সবার কাছে পাখিশিকারি হিসেবেই পরিচিত।
বাঁশবাগানের ওপর বকের সারি বিশ্রাম নেয়। এই সুযোগে অনীল বক শিকার করে। গতবার বর্ষাকালে বক শিকার করে কিছু টাকাও কামিয়েছে সে। এছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির পাখি শিকার করে হাটে বেচে অনীল। বিক্রি করে পায় টাকা। এই নেশায় থাকে তার হাতে গুলতি। প্রতি বছর শীতকালে বাংলাদেশে আসে নানান প্রজাতির অতিথি পাখি। শিকারিরা ব্যস্ত হয়ে ওঠে পাখি শিকারে। যার কারণে এখন পাখিদের আনাগোনা অনেকটা কমে গেছে। অনীল প্রতিদিনই পাখি শিকার করে।
একদিন সকালবেলা খাবার খেয়ে বের হয় শিকারে। মাঠের ওপারে ঘন আমের বাগান। এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। কোথাও কোনো পাখি দেখা যায় কিনা। হঠাৎ চোখে পড়ে ছোট লেজবিশিষ্ট একটি হলদেপাখি এডাল-ওডাল উড়ে বেড়াচ্ছে। পোকা-মাকড় পেলে ঠুকরাচ্ছে ঘন-ঘন। মনে হয় সকালের খাবার খেতে বের হয়েছে পাখিটি। অনীল তার গুলতি তাক করল পাখিটির দিকে। কিন্তু পাখিটির নড়াচড়ার কারণে তাক স্থির করতে পারছে না। হঠাৎ গুলতি থেকে গুলি ছুড়ে অনীল। পাখিটির পায়ে গিয়ে লাগে। ধপাস করে পড়ে গেল নিচে। দৌড়ে গিয়ে ধরল পাখিটি। বাংলাদেশের সবখানে এই পাখিটি ইস্টিকুটুম বা বেনেবউ হিসেবে পরিচিত। পাখিটির পায়ে চোট লেগেছে। তবে পা ভেঙে যায়নি। অনীল হলুদবরন পাখি আরও দেখেছে। কিন্তু এই পাখিটি তার খুব ভালো লেগে গেল। সেজন্য বিক্রি করার চিন্তা তার মাথায় আসছে না। এটাকে খাঁচায় রেখে পুষবে বলে মনস্থির করল। বাড়িতে থাকা একটি চিকন লোহার খাঁচায় বন্দি করল পাখিটি। খাঁচায় বন্দি পাখি দানাপানি পেলেও তা খেতে চায় না। সারাক্ষণই ছটফট করে মুক্ত হতে । অনীল আধার আর দানা দিলেও পাখিটি ঠিক মতো খায় না। না খেতে-খেতে পাখিটির দেহ যেন ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে। অনীলের মা এসব বিষয়ে বারণ করলেও তা সে আমলে নেয় না। মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে প্রতিদিন এ সমস্ত কাজকর্ম করে বেড়ায়।
শুক্রবার সকালবেলা। অনীল পাখি শিকার করতে বের হয়। পাড়ার কিছু ছেলেমেয়ে আজ মাঠে নেমেছে খেলতে। খেলার জমজমাট দৃশ্য দেখে সেও নেমে পড়ল খেলায়। খেলার মাঝখানে পক্ষ-বিপক্ষের তর্কাতর্কি হয়। অনীলের সমবয়সী নিলু। সে খুব ভদ্র এবং মেধাবী। পাড়ার সব ছেলে তাকে ভদ্র নিলু বলেই ডাকে। নিলু অনীলকে তর্ক করা ভালো নয় বলতেই অনীল নিলুকে মাথায় আঘাত করে। নিলু জ্ঞান হারায়ে মাটিতে লুটে পড়ে। এ নিয়ে পাড়ার মাঝে হৈ চৈ পড়ে যায়। নিলুর বাবা থানায় মামলা করে। অনীলকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তিনদিন পর কিশোর অপরাধ আর পাখিশিকারের কারণে অনীলের দু’মাসের জেল হয়। অনীলের মা ছেলের জামিন পেতে বড় উকিল ধরেন। এক মাস বারোদিনের মাথায় অনীল জেল থেকে ছাড়া পায়। বাড়ি ফেরার পথে অনীল তার মায়ের কাছে খাঁচার পাখিটি সম্পর্কে জানতে চায়। মা বলে, পাখিটি আমি ছেড়ে দিয়েছি। যদি না ছেড়ে দিতাম তাহলে পাখিটি মারা যেতো। অনীল মায়ের কথা শুনে মুচকি হাসে। মায়ের হাত ধরে কান্না করতে থাকে। অনুশোচনায় বলতে থাকে, আমি ভুল করেছি মা। আমি আর কখনো পাখিশিকার করব না। তুমি পাখিটি ছেড়ে দিয়ে বেশ করেছ। আমি এতদিন বন্দি ছিলাম লোহার খাঁচায়। মুক্ত হওয়ার সাধ কতটুকুন তা আমি টের পেয়েছি এই কয়েকদিনে। ছটফট করেছি কখন জেল থেকে বের হবো। আমার মতো পাখিটিও ছটফট করতো রোজ। কিন্তু আমি তা বুঝিনি। মুক্ত হয়ে চলার সাধ যে কি তা আজ বুঝি।
মা ছেলের মুখে এসব কথা শুনে ভীষণ খুশি হয়। এরপর থেকে অনীল আর পাখিশিকার করে না। কেউ পাখিশিকার করলে তাতে বাধা দেয়। সব ছেলেমেয়েদের সাথে মিলেমিশে চলে। হলুদপাখিটির ছটফটানি তার চোখে ভাসে। মনে-মনে ভাবতে থাকে, আমার মতো পাখিটিও মুক্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝিনি। অনীল মুক্ত পাখিকে খাঁচায় পুষতে গিয়ে নিজেই বন্দি হয়ে গেল ভাগ্যের কাছে।
অনীল ঘটে যাওয়া এ ঘটনা থেকে শিক্ষা নিল। পাখির মতো মুক্ত হয়ে থাকতে চায় সে।