নিজস্ব প্রতিবেদক »
রাত হলেই চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেলপথের পটিয়া রেলস্টেশন যেন মানুষ আর মাছের পোনার মিলনমেলা। প্রতি বছর জুন থেকে আগস্ট এ তিন মাস এ দৃশ্য দেখা গেলেও এ বছর একটু দেরিতে তা দেখা গেল। স্টেশন চত্বরেই পোনা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম ‘মিয়েইল্যা-মিয়েইল্যা’, দুয়েইল্যা-দুয়েইল্যা।
মিয়েইল্যা বলতে কয়েক ধরনের পোনার মিশ্রণকে স্থানীয় ভাষায়-মিয়েইল্যা বলে। দুয়েইল্যা বলতে দুই আঙ্গুল সমান পোনাকে দুয়েইল্যা বলে। রাত ১১ থেকে পটিয়া রেল স্টেশন চত্বরে পোনা বিক্রেতারা কাঁধে ভার নিয়ে আসে। ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে পোনা বিকিকিনি। চট্টগ্রামের স্থানীয় উপজেলাগুলো ছাড়াও কক্সবাজার, টেকনাফ, উখিয়া, বাঁশখালী, বান্দরবন, রাঙামাটি, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, খাগড়াছড়ি জেলা-উপজেলা থেকে পোনা ক্রয়ের জন্য লোকজন আসেন এ স্টেশনে। রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, পাঙ্গাস, মাগুর, সিলভার কার্প, থাই মাগুর, সরপুঁটি, বিগহেড, গ্লাস কার্প, শিং, চিতলসহ অনেক মাছের পোনা বিক্রি হয়। প্রতি ভারে ৬ কেজি অথবা ৮ কেজি পোনা থাকে। পোনার জাত ভেদে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা বিভিন্ন দরে বিক্রি হয়ে থাকে।
পটিয়া উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মাছ চাষ ও রেণু উৎপাদন হয়ে থাকে। হাটহাজারীর হালদা নদীর ডিম এনে মাছের রেণু উৎপাদন করার পর চাষিরা তা পোনায় রূপান্তর করে। হালদা নদীর মাছের ডিম থেকে সৃষ্ট পোনা উন্নতমানের এবং বড় জাতের মাছ হয় বলেই মাছ চাষিরা হালদার পোনার প্রতি আকৃষ্ট বেশি। পটিয়ায় পোনা উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা হালদা নদীতে মাছ ডিম ছাড়ার সাথে সাথে অধিকাংশ ডিম পটিয়ায় সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। মাছের জন্য পটিয়ার জলাশয়গুলোর পানি অতি উপযোগী হওয়ার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর মধ্যে হাইদগাঁও, কচুয়াই, কেলিশহর, খরনা, খানমোহনা, ধলঘাট, আশিয়া, জঙ্গলখাইন, হুলাইন, জিরি, কাশিয়াইশ, শিকলবাহা, শোভনদ-ীসহ পটিয়া পৌর এলাকা এবং পশ্চিম পটিয়ার কর্ণফুলী থানার অধীনে কয়েকটি এলাকার পুকুরগুলোতে পোনা চাষ করেন পোনা ব্যবসায়ীরা। সেসব এলাকা থেকে পোনা সংগ্রহ করে পটিয়া পৌরসদরের রেলস্টেশন বাজারে এনে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। বছরের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পোনা বিক্রির মৌসুম হওয়ায় রেলস্টেশনের পোনার বাজার এ চার মাস জমজমাট থাকে বলে পোনা ব্যবসায়ীরা জানান। এ স্টেশনে প্রতিদিন ৩০/৩৫ লাখ টাকার পোনা বিক্রি হয়। সেই সাথে মাছচাষকে কেন্দ্র করে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে পটিয়ায়। কর্মসৃজন হয়েছে হাজারো বেকারের।
জানা যায়, উপজেলায় ৪ হাজার ১৯৯ একরের জলায়তনের মধ্যে পুকুরের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ হাজার। তারমধ্যে আবাদি সাড়ে ৯ হাজারটি। মাছের জন্য জলাশয়গুলোর পানি অতি উপযোগী হওয়ার কারণে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোর মধ্যে হাইদগাঁও, কচুয়াই, কেলিশহর, খরণা, খানমোহনা, ধলঘাট, আশিয়া, জঙ্গলখাইন, হুলাইন, জিরি, মনশা, হাবিলাসদ্বীপ, ধলঘাট, গৌড়লা, কাশিয়াইশ, শিকলবাহা, শোভনদন্ডীসহ পটিয়া পৌর এলাকা এবং পশ্চিম পটিয়া কর্তফুলী থানার অধীনে বেশ কয়েকটি এলাকার পুকুরগুলোতে পোনা চাষ করে থাকেন ব্যবসায়ীরা। সেসব এলাকা থেকে পোনা সংগ্রহ করে পৌরসদরের রেলস্টেশন বাজারে এনে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন। বছরের জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পোনার বিক্রির মৌসুম হওয়ায় রেলস্টেশনের পোনার বাজারে এ চার মাস জমজমাট থাকে বলে পোনা ব্যবসায়ীরা জানায়। এছাড়া চার মাসের মৌসুম ছাড়াও সারা বছর এ বাজারের আশেপাশে গড়া ওঠা পোনা বিক্রয় কেন্দ্রে পোনা ও চাষ উপযোগী মাছ বিক্রি হয়।
পোনা ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান জানায়, চট্টগ্রাম ছাড়াও কক্সবাজার, পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির এলাকার মাছ ও পোনা ব্যবসায়ীরা পটিয়ার রেল স্টেশন বাজার থেকে পোনা নিয়ে মাছ চাষ করে থাকেন। এছাড়া পটিয়ায় উৎপাদিত নানা প্রজাতির পোনা ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাত ১১টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত চলে পোনার বাজার। এসময় ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠে রেলস্টেশনের আশপাশের আধা কিলোমিটার এলাকায়। ক্রেতাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য পোনা বিক্রেতারা ‘মিয়েইল্যা-মিয়েইল্যা’ (কয়েক ধরনের পোনার মিশ্রণকে স্থানীয় ভাষায় মিয়েইল্যা বলে), ‘দু’অঁইল্যা হাতাল- দু’অঁইল্যা হাতাল’ অর্থাৎ দু’আঙ্গুলের সমান কাতলা পোনা, বিক্রিতব্য পোনার ধরনের উপর বিভিন্ন ধরনের ডাক হাঁকে। প্রতিরাতে ১২০০-১৫০০ ভাড় (দুই কলসিতে একভাড়) পোনা বিক্রির জন্য এ বাজারে আসে পোনা ব্যবসায়ী বিক্রেতারা। অনেকে মাছ ও পোনা বেচা কেনা নিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী ও ফাঁড়িয়া ব্যবসা করছে। এই ব্যবসাকে উপজীব্য করে ৩০ হাজার মানুষ জীবন জীবিকা নির্বাহ করছে।
পোনা বহন শ্রমিক আলম, জাহাঙ্গীর ও দেলোয়ার বলেন, প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় করেন তারা।
রেলস্টেশনের পোনার বাজার ছাড়াও পটিয়ায় একটি সরকারি মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র ও বেসরকারি মৎস্য পোনা উৎপাদনকারীগুলোর মধ্যে হযরত ওয়াশিল ফকির মৎস্য হ্যাচারি, মায়ের দোয়া মৎস্য খামার, ইউনাইটেড এ্যাকুয়া ফার্মস, জম জম ফার্মস, শাহ আমানত হ্যাচারী, তাহের শাহ মৎস্য আড়ৎ, হক এগ্রোভেট হ্যাচারিসহ আরো অনেক স্থানে পোনা বিক্রি হয়।
মৎস্য হ্যাচারির মালিকরা জানায়, এ পোনার বাজারে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, পাঙ্গাশ, মাগুর, সিলভার কার্প, থাই মাগুর, সরপুঁটি, বিগহেড, গ্রাস কার্প, শিং, চিতলসহ আরো অনেক মাছের পোনা বিক্রি হয়।
সাতকানিয়া থেকে আসা মৎস্য প্রজেক্টের রফিকুর নবী নামের এক ক্রেতা জানায়, ‘আষাঢ়-শ্রাবণ পুকুরে পোনা ছাড়ার সময়। পোনা ভালো জাতের হলে পুকুরে মাছ যেমন বাড়বে, তেমনি স্বাস্থ্যবান হবে। পটিয়ায় ভালো জাতের পোনা জন্মে। তাই প্রতি মৌসুম এখান থেকেই পছন্দের পোনা সংগ্রহ করি।
তিনি আরো বলেন, গত বছর এক একরের একটি পুকুরে দশ হাজার টাকার পোনা ছেড়ে দেড় লাখ টাকা আয় করেছি।
পোনা ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, ভার করে বিক্রি করা হয় রুই, কাতলা, সরপুটি, মৃগেল, গ্রাস কাপ আর ইঞ্চি হিসেবে বিক্রি করে পাঙ্গাস, মাগুর, কই, চিতল, দেশি মাগুর, শিং মাছের পোনা। আর এ বাজারে প্রতিদিন সাতশ’ থেকে এক হাজার ভার মাছের পোনা বিক্রি হয়। রুই, কাতলা, মৃগেল-এ তিন প্রকার পোনা একসঙ্গে বিক্রি করা হয় বলে এর নাম ‘মিয়েইল্যা’। দুটি ডেক্সি নিয়ে হয় এক ভার। এক ডেক্সিতে চার-ছয় কেজি, আর এক ভারে হয় আট থেকে দশ কেজি পরিমাণ পোনা। প্রতি ভার ৭/৮ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। এছাড়া ইঞ্চি হিসাবে বিশেষ করে চিতল মাছের পোনা একশটির মূল্য সাড়ে ৩ হাজার টাকা। এভাবেই বিক্রি হয় এখানের পোনাগুলো। সব মিলিয়ে প্রতিদিন এ বাজারে প্রায় ১০/১৫ লাখ টাকার পোনা কেনা বেচা হয়।
এক হিসাবে দেখা দেখে প্রতিবছরে মৌসুমের সময় চার মাসে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ হিসাব করে প্রায় ১২ কোটি টাকার অধিক পোনার বাণিজ্য হয় এ বাজারে।
কামাল বাজারের মায়ের দোয়া মৎস্য খামারের মালিক মো. সোহেল বলেন, প্রতিদিন এ বাজার রাত ১১টার পর শুরু হয়ে শেষ রাত পর্যন্ত চলে। বছরের জুন থেকে অক্টোবর এ চার মাস এ বাজার জমজমাট পোনা কেনা বেচা হয়। এছাড়া বছরের অন্যান্য দিনে পুকুরে নেটের মাধ্যমে পোনা বিক্রি করে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমার ২০টির অধিক পুকুরে পোনা চাষ করি। এসব পুকুর থেকে পোনা সংগ্রহ করে রেলস্টেশনের পোনার বাজারে বিক্রি করি।
তিনি বলেন, এখানে অনেকে পোনা চাষ ও বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে। তিনি এ সম্ভাবনাময় খাতকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির জন্য সরকারিভাবে ঋণদানের ব্যবস্থা করে দেয়ারও আহ্বান জানান।