হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ্ তাআলা সমস্ত প্রশংসার মূল মালিক। তিনি সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি এক, তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর সমকক্ষ কেউ নাই,কিছু নাই। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নাই। তাঁর কোন শরীক নাই।
আমাদের প্রিয় নবী আল্লাহর প্রেরিত সর্বশেষ পয়গম্বর। তাঁর হাতে নবুওয়তের ধারা সমাপ্ত হয়। তাঁর পরে কোন নবী আসবেন না। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তার ঈমান থাকবে না। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে আল্লাহ্ তা’আলা সর্ববিধ নেয়ামত দানে সকল যোগ্যতায় সর্বশ্রেষ্ঠ বানিয়েছেন।
আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ ও নেয়ামতকে তিনি চার স্তরের বান্দাদেরকে দান করেছেন। ফলে এগুলো চারস্তরে চার নামে বিন্যস্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “যাঁরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তাঁরা রোজ হাশরে সেই পুণ্যাত্ম বান্দাদের সাহচার্যে থাকবেন, যাঁদেরকে আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন। তাঁরা হলেন নবীগণ, সিদ্দীকগণ, শহীদান এবং সালিহী তথা বুযুর্গানে দ্বীন।” (৪:৬৯) বিশুদ্ধ আকীদা হলো নবীগণ মা’সুম, অর্থাৎ নিষ্পাপ। তাঁদের শানে যারাই দোষ, গুনাহ্ বা পাপ লেপন করবে, তারা পথভ্রষ্ট, ভ্রান্ত সম্প্রদায়। পরবর্তী স্তরে আছেন সিদ্দীকগণ। আল্লাহর কুরআনে হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত মরিয়ম (আ.) কে ‘সিদ্দীক’ বিশেষণ প্রদত্ত হয়েছে। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আল্লাহর রাসূলের একান্ত সহচর হযরত আবু বকর (রাদ্বি.) ইসলামে বিশ্বাসী সকলের কাছে ‘সিদ্দীক’ পরিচয়ে সমাদৃত। ৩য় স্তরে আছেন দ্বীন-ধর্মের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারকারী, দ্বীনের স্বার্থে আত্মত্যাগী, জীবনদানকারী শহীদান, যাঁরা মরেও অমর, যাঁদেরকে এ অবিনাশী জীবন দানের কথা স্বয়ং আল্লাহই ঘোষণা করেছেন। আর আজকের আলোচনা তাঁদের শান ও মান নিয়ে। ৪র্থ প্রকারে রয়েছেন বেলায়তের অধিকারী আল্লাহর ওলী-আওতাদগণ। যাঁদেরকে তিনি নির্ভয়, নিঃশঙ্ক জীবনের সুসংবাদে ধন্য করেছেন।
শাহাদত দুই প্রকার। যথা : শাহাদতে জিহ্রী বা প্রকাশ্য শাহাদত এবং শাহাদতে সিররী বা অপ্রকাশ্য শাহাদত। প্রথমোক্ত শাহাদতের স্বরূপ হচ্ছে, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন বিশ্বাসী বান্দার আল্লাহর বাণী সমুন্নত রাখতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ.)’র শত্রুর মোকাবেলায় কঠিন থেকে কঠিনতর দুঃখ কষ্ট সহ্য করে জীবন বিসর্জন দেয়া। অথবা অন্যায়-যুলুমের শিকার হয়ে নিহত হওয়া। শেষোক্ত শাহাদত হচ্ছে; বিষ প্রয়োগে, প্লেগ, মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে, প্রাকৃতিক দুর্ঘটনায়, অগ্নিকা- বা ধ্বসের কবলে পড়ে, জলমগ্ন হয়ে, ইলমে দ্বীন অর্জন অবস্থায় মারা গিয়ে, হজ্বের সফরে মারা গিয়ে কিংবা কঠিন পেটের পীড়া, কিংবা দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কারো জীবন অবসান হয়ে শাহাদতের মর্যাদা পাওয়া। মোদ্দা কথা, এর শাব্দিক অর্থ সাক্ষ্য প্রদানকারী। যে দ্বীনের যথার্থতা প্রমাণ বা প্রচার বা প্রতিষ্ঠার জন্য অস্ত্র প্রয়োগের মোকাবেলা, কিংবা শত্রুর ঘায়ে নিহত হয়ে দ্বীন’র সত্য ও বাস্তবতার সাক্ষ্য আনেন তাঁকে শহীদ বলা হয়। (ইমাম রাযী (রহ.) কৃত তাফ. কাবীর)
আল্লাহ তাআলা নবীজির ইহজীবন রক্ষা করার কথা পাক কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন। তাই তাঁকে শত্রুরা যুদ্ধের ময়দানে হত্যা করতে অপারগ হয়। নয়তো তাঁর ওপর প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ও ষড়যন্ত্র পূর্বক প্রাণঘাতি হামলা বহুবার হয়েছে। হিজরতের পথে শত উটের পুরস্কারের লোভে আরবের যুবকেরা খোলা তরবারি নিয়ে তাঁর সামনেই এসে পড়েছিল। খায়বর যুদ্ধে যয়নব নামী ইহুদী রমণী বিষ মিশ্্িরত ভুনা গোশত তাঁর কাছে পাঠিয়েছিল, তা থেকে তিনি এক টুকরো মুখেও দিয়েছিলেন। তা কিন্তু বিষক্রিয়া করেনি। অথচ ওই গোশত খেয়ে বিশির ইবনে বারা নামক এক সাহাবী তাৎক্ষণিক শাহাদত বরণ করেন।
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও তাঁর প্রতিশ্রুতি প্রতিদানের প্রত্যাশায় তাঁর প্রতিটি প্রেমিক বান্দাই শাহাদতের প্রত্যাশা পোষণ করেন। সৌভাগ্যবান বান্দারা তা লাভ করেন। নবীজিও এ নেয়ামত বঞ্চিত হননি। তবে তাঁর সে আকাক্সক্ষা পরোক্ষভাবে ও প্রকারান্তরে পূর্ণ করা হয়। ইমাম বুখারী ও ইমাম বায়হাকীর (রা.) লিপিবদ্ধকৃত মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাদ্বি.) হতে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (দ.) তাঁর অন্তিম রোগশয্যায় প্রায় বলতেন, “খাবারে বিষমিশ্রিত গোশত খেয়ে তার বিষক্রিয়ার যন্ত্রণা আমি বাকী জীবন ভোগ করে এসেছি। এখন সময় উপস্থিত, সে ক্রিয়ায় আমার জাগতিক জীবনের রগ ছিন্ন হবে।” এটা তাঁর বিলম্বিত জিহ্রী শাহাদতের সূক্ষ তথ্য। বিলম্বিত হওয়া ছিল তাঁর মু’জিযা।”
এবার আরেকটি হাদীস শরীফ দেখা যাক। আমীরুল মু’মিনীন, মাওলায়ে কায়েনাত শেরে খোদা হযরত আলী (রাদ্বি.) বর্ণনা করেন, “হাসান ইবনে আলী (রাদ্বি.) পবিত্র বুক হতে শির মুবারক পর্যন্ত আল্লাহর রাসূল’র সাদৃশ্য ম-িত, আর হুসাইন ইবনে আলী বুক হতে পা পর্যন্ত রাসূলেরই দৃশ্যমান অবয়ব যেন” (তিরমিযী শরীফ)।
মিশকাতে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রাসূলে করীম (দ.)’র ইরশাদ, “হাসান ও হুসাইন (রাদ্বি.) এঁরা দু’জনেই দুনিয়াতে আমার বেহেশতী দু’টি ফুল।” একথাও অনস্বীকার্য যে, ফল-ফুলে, রূপ-রস, বর্ণ-গন্ধ মূলত শেকড় থেকেই আসে। তাই উভয় দিকে স্বাদ ও গন্ধ প্রায় ক্ষেত্রে অভিন্ন। ‘শেকড়’র আরেক অর্থও মূল। মূল’র প্রস্ফুটন ফল-ফুল।
আমাদের কাছে আরেকটি তথ্য সর্বজনবিদিত যে, ইমাম হাসান ইবনে আলী (রাদ্বি.) কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হয়েছিল। এ শাহাদতের না রাসূল ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, না স্বয়ং ইমাম হাসানও। অব্যক্ত বা গোপন শাহাদতকে ‘সিররী শাহাদত’ বলা হয়, যা পূর্বেই বলা হয়েছে। আর ইমামদ্বয়ের দু’প্রকার শাহাদত কুদরতের ব্যবস্থায় পরোক্ষভাবে আল্লাহর রাসূলের হিস্যায় ধর্তব্য হয়। কারণ, এঁরা দু’জন রাসূলেরই দু’টি ফুল, তাঁর রূপ-রস-গন্ধে বিকশিত ও সুরভিত। নবীজি তাঁদেরকে শিশু বয়সে শুঁকে শুঁকে বেহেশত’র সুঘ্রাণ নিতেন। আল্লাহই জানেন, সে খোশবু তাঁরই নূরানী দেহের অভিন্ন সুরভি হতে পারে। শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের কেউ কেউ এও বলেছেন, এঁরা আলীর চেয়েও রাসূলের সাদৃশ্য আর গুণপনা অধিক পেয়েছেন। তাই তাঁদের শাহাদতে নবীজির শাহাদতই পরোক্ষে বাস্তবায়িত হয়েছে, এটা অতিরঞ্জন তো নয়।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহর রাহে নিহত (শহীদ)গণ জীবিত।’ তাঁদের ‘মৃত ’ বলাও যাবে না, ধারণাও করা যাবে না। শহীদ হয়ে যাওয়ার পর ইমামের দলিত-মথিত দেহ মুবারক হতে পবিত্র মস্তক বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিল অভিশপ্ত ইয়াযীদের বর্বর সৈন্যরা। সেই কর্তিত শির মুবারক বর্শার ডগায় গেঁথে বিজয়োল্লাস করে তারা যখন কুফার রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন আসহাবে কাহ্ফ’র প্রসঙ্গ বর্ণিত আয়াত কেউ পথের ধারে পড়ছিল। তখন ইমামের শির তার জবাবে কথা বলেও উঠেছিল। এ শির মুবারকই ভক্তির দৃষ্টিতে দর্শনরত এক গীর্জার পাদ্রীর অন্তর জগত উদ্ভাসিত করায় তার মুখে কলেমা এসে যায়। এটা বাস্তব জীবনের চাক্ষুষ প্রমাণ, শহীদের জীবন্ত রূপ।