মাহবুবুল হক : সাহিত্য-নিবেদিত প্রাণ

শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহীবুল আজিজ »

১৯৭৭-৭৮ সালে আমরা চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পতাকাতলে সম্মিলিত হই সুস্থতাঅন্বেষী ছাত্ররাজনীতির লক্ষ্যে। তখন সামরিক স্বৈরাচারের কাল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের করাল ছায়ায় গ্রাসিত নানাবিধ অর্জন। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল উদ্বেগাক্রান্ত। কলেজ-ক্যাম্পাসগুলো তখন সচেতন ছাত্ররাজনীতির মুখরতায় দারুণ রকম স্পন্দমান ছিল। সেসময়টাতেই একদিন পরিচয় হয়েছিল মাহবুবুল হকের সঙ্গে। পরে তিনি ড. মাহবুবুল হ’ন কিন্তু আমাদের পরিমণ্ডলে সকলেরই প্রিয় মাহবুব ভাই। কিন্তু আমাদের আরও ভাই ছিলেন। একটা বিখ্যাত ট্রায়ো ছিল আমাদের ছাত্র ইউনিয়নকেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধফেরত মাহবুবুল হকেরা সেসময় বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পাির্টর রাজনীতির সক্রিয় কর্মী এবং নেতৃস্থানীয়ও বটে। চন্দনপুরায় ছিল ‘বর্ণরেখা প্রেস’ যেটির কর্ণধার ছিলেন মাহবুবুল হক এবং গিয়াস উদ্দিন ওরফে গিয়াস ভাই। এদিকে চট্টগ্রাম পৌরসভা (তখনও কর্পোরেশন হয় নি।) এবং হোটেল ইন্টারন্যাশনালের মাঝখানটাতে ছিল মডার্ন প্রেস যেটির অন্যতম কর্ণধার বা ব্যবস্থাপক ছিলেন আবদুল হান্নান বা হান্নান ভাই। এই তিন ভাইয়ের ট্রায়ো নানা উপলক্ষ্যে আমাদের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁদের তিনজনের মধ্যে ছিল দারুণ সখ্য। সেটা হতে পারে তাঁরা একই রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী ছিলেন সেজন্যে। চট্টগাম কলেজ সংস্কৃতি সংসদের বিভিন্ন প্রকাশনার কাজে আমাদের আশ্রয় ছিল, হয় বর্ণরেখা নয় মডার্ন। বর্ণরেখায় মাহবুবুল হকের নির্দেশনা পরামর্শ এবং মুদ্রণ-প্রকাশনাসংক্রান্ত ইত্যাকার তৎপরতায় আমরা একটা এককেন্দ্রিকতায় পরস্পরের নিকট সন্নিধানে পৌঁছে যাই। পরে সেই নৈকট্য প্রগাঢ় হয়েছে। আজ সেই বন্ধনটা ছিন্ন হয়ে গেল প্রকৃতির নির্মম অথচ অমোঘ নিয়মতন্ত্রের পরিণামে।
ছাত্ররাজনীতির বামপন্থার কারণে তিনি বরাবর এস্টাবলিশমেন্টের রোষানলে ছিলেন। বিশেষ করে ডানপন্থী এবং স্বৈরাচারী সরকারের অপতৎপরতার কারণে তাঁর পক্ষে বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করা সম্ভব হয় না। হলে তিনি আমার সরাসরি শিক্ষকই হতেন। কারণ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় বাংলা বিভাগে তাঁর অনুজদের অনেকেই আমার শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় কলেজে যোগ দেন এবং আরও পরে যোগদান করেন তাঁরই ছাত্রজীবনের বিশ^বিদ্যালয় বাংলা বিভাগে শিক্ষকতায়। সেখানে তাঁর সঙ্গে দারুণ সময় কাটতো আমাদের। পূর্বপরিচিত হওয়ার সুবাদে এবং মানসিক প্রবণতায় কিছু মিল থাকার কারণে তাঁর সঙ্গে আড্ডা-আলাপ চলতো দ্রুতরেখ সম্পন্নতায়। আমাদের দু’জনের ছিল আরেক অভিন্ন কেন্দ্রিকতা—চৌধুরী জহুরুল হক, যাঁর সম্পর্কে এস্থলে বিশেষ কিছু বলবার প্রয়োজন পড়ে না। মাঝে-মাঝে আমরা মানে আমি আর মাহবুব ভাই এমন মধুর বিতর্কেরও অবতারণা করতাম, আমাদের দু’জনের মধ্যে জহুরুল হক স্যার কাকে বেশি স্নেহ করেন। সমাধান আমিই দিতাম: বলতাম, আপনি স্যারকে ‘ভাই’ সম্বোধন করেন আমি বলি ‘স্যার’। যে-কোনো বিচারে স্যারের চেয়ে ভাইয়ের হৃদয়াবেশ অধিকই হওয়ার কথা। এমন দিন যায় নি আমরা ক্লাসের অবসরে কোনো না কোনো বিষয়ে আলাপ জমাই নি। মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে আরও নানা কারণে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। আমাদের দু’জনেরই প্রিয় খেলা ছিল দাবা এবং আমরা বহুদিন দাবা খেলেছি একসঙ্গে। মাহবুব ভাইয়ের ব্যক্তিগত কক্ষে আরও একজন দাবাড়ু আসতেন চট্টগ্রাম সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের দর্শনের শিক্ষক জাকির ভাই। মাহবুব ভাইয়ের প্রিয় লাইন ছিল পেট্রফ রীতিতে খেলা। আর আমার ছিল টোরে ওপেনিং। মজা করবার জন্য বলতাম, আপনি তো রাশিয়াতে ছিলেন এবং ম্যাক্সিম গোর্কির ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন, তাই আপনি রুশ রীতির অনুসারী। স্বভাবসুলভ সরল হাসিতে পরিস্থিতি কৌতুকপ্রদ করে তুলতেন।
দাবার বোর্ডে বসতাম বটে কিন্তু আলাপ হতো সাহিত্য বিষয়েই মূলত। আরও একটু স্পষ্ট করে বললে ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে। একদিন আন্দরকিল্লা’র নেয়ামত উল্লাহ বুক থেকে তাঁর রচিত ম্যাক্সিম গোর্কির মা সম্পর্কিত বইটা সংগ্রহ করে তাঁকে বলি, আপনার একটা অটোগ্রাফ দিন। হাসতে হাসতে তিনি বললেন, এ-বই আপনি পেলেন কোথায়, এ তো অনেক আগেকার মুদ্রণ। এটার দ্বিতীয় মুদ্রণ বেরোবে। বেরিয়েছিল সেটা। একদিন চা খেতে-খেতে প্রসঙ্গক্রমে তাঁকে বললাম ‘স্পাসিভা’ মানে ধন্যবাদ। অবাক হয়ে বললেন, আপনি রুশ ভাষা জানেন? আসলে তাঁকে খানিকটা চমকে দেওয়ার জন্য আমি শব্দটা উচ্চারণ করি। কিন্তু তিনি আমাকে পরামর্শ দেন, রুশ ভাষার মহৎ সাহিত্যগুলো মূল ভাষায় পড়লে তা যে কী আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয় সেটা অবর্ণনীয়। আমি তাঁকে বলি, সেটা রুশ কেন যে-কোনো মূল ভাষার সাহিত্য সম্পর্কে প্রযোজ্য। মনে পড়ে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসি ভাষা শিখে বোদল্যারের ‘লে ফ্ল্যুর দ্যু মাল’ পড়ার সেই অসাধারণ স্মৃতি। শৈশবে বাবার উৎসাহে আরবির পাশাপাশি খানিকটা ফারসি শেখার কারণে রুমির ‘মসনভি’ মূল ভাষায় পড়বার আনন্দ। এখনও কানে বাজে সেই উচ্চারণÑবেশ্নো আজ নেয়ি চুন্ হেকায়াৎ মি কুনাদ্/ আজ জুদায়ি হ শেকায়াৎ মি কুনাদ। এসব বলবার কারণ আছে। মাহবুব ভাই এবং চৌধুরী জহুরুল হক স্যার দু’জনেই আমাকে বিদেশি ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদের ব্যাপারে আত্যন্তিক ধরনের উৎসাহ দিতেন। ১৯৯৭ সালে আমি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসি এবং আমার সঙ্গে থাকে ঈডিশ ভাষার লেখক আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের ‘শোশা’ উপন্যাসের হাতে লেখা বাংলা ভাষান্তরের পাণ্ডুলিপি। সেটা জেনে অসীম আনন্দ উপচে পড়ে মাহবুব ভাই এবং চৌধুরী জহুরুল হকের মনে। তাঁদের উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছিল, অনুবাদক আমি নই, তাঁরাই। মাহবুব ভাই বলতে থাকেন, কী বলেন মহীবুল, এটা একটা বিরাট ব্যাপার, ২৫০ পৃষ্ঠার এমন একটি উপন্যাস আপনি অনুবাদ করেছেনএবং তা এমন একজন লেখকের যাঁর কোনো গোটা উপন্যাসের অনুবাদক উভয় বাংলায় আপনিই। সেখানেই তিনি থেমে থাকেন না। আমি বলবার আগেই আমাকে নিয়ে মাহবুব ভাই এবং জহুর স্যার গেলেন দৈনিক আজাদী’র সাহিত্য সম্পাদক সাংবাদিক অরুণ দাশগুপ্ত’র বাসায়। বৌদ্ধ মন্দিরের উল্টোদিকে আলোকন ্স্টুডিও’র লাগোয়া সেই বাসায় (এখন সেখানে বহুতল ভবনের অবস্থিতি।) আমার অনুবাদের সূত্রে নিকটের ফতেয়াবাদ হোটেলের মিস্টি সিঙ্গারা এবং চায়ের সহযোগে উদযাপিত হলো একটা অনানুষ্ঠানিক কিন্তু সপ্রাণ উপলক্ষ্য। সেখানেই ঠিক হলো দৈনিক আজাদী’র সাহিত্য-পাতায় আমার অনূদিত উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে ছাপা হবে। আমি একটু অপ্রতিভ স্বরে বলি, মালেক সাহেব কী দীর্ঘকাল উপন্যাসটি ছাপবেন তাঁর পত্রিকায়! ‘আলবৎ ছাপবেন’—জোরের সঙ্গে বলেন জহুর স্যার এবং মাহবুব ভাই দু’জনেই। ‘শোশা’ পরবর্তীতে ঢাকা থেকে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয় কিন্তু মাহবুব ভাই এবং জহুর স্যার উৎসাহ না যোগালে এবং অরুণ দা’ পৃষ্ঠপোষণা না করলে সেটি হয়তোবা কখনোই পত্রিকার পাতায় প্রকাশ পেতো না।
আজ মাহবুবুল হকের প্রয়াণের সংবাদে এসব কথা স্মৃতির জলভ্রমির মত ঘুরপাক খেতে থাকে। ভাষা-সাহিত্য বিষয়ে তাঁর আত্মনিবেদন ছিল অনুসরণযোগ্য। সেটার প্রমাণ তিনি রেখে গেছেন তাঁর লেখা ভাষাসম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণায়। বহুবার তাঁকে বলেছি, মাহবুব ভাই আপনি তো কিছু সৃজনশীল কাজ করতে পারেন। যেমন গোগোল তলস্তোয় দস্তয়েভস্কি তুর্গেনিয়েফ চেখভ গোর্কি এঁদের বিখ্যাত গল্পগুলো মূল রুশ থেকে অনুবাদ করলে তা আমাদের সাহিত্যজগতকে সমৃদ্ধ করবে। এসব নিয়ে কথা হতো প্রায়শ। আমি নিজে ছাত্রজীবন থেকে ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী। মাহবুব ভাইকে একবার বলেওছি—হ্যাঁ, পৃথিবীর সেরা উপন্যাস হয়তো ব্রাদার্স কারামাজভ, ক্রাইম এ্যান্ড পানিশমেন্ট, ওয়ার এন্ড পিস, আনা কারেনিনা এইসব রুশ সাহিত্যই কিন্তু যে-উপন্যাসটি আমি প্রতিটি মুহূর্তে আমার টেবিলে রাখি সেটি হলো শার্লোট ব্রন্টির ‘জেন আয়ার’। মাহবুব ভাই বলেন, হতে পারে আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে উপন্যাসটির কোনো যোগসূত্র রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, কোথায় যেন অনাথ জেন-এর সংগ্রামশীলতার সঙ্গে আমার একটা মিল খুঁজে পাই। জেন অনেকবারই মৃত্যু থেকে বেঁচে যায় এবং আমার সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অন্তত পাঁচবার। তখনই কথায় কথায় আসে মুক্তিযুদ্ধের কথা। কিভাবে তাঁরা দেশ স্বাধীন করবার জন্য নানা প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে ভারতের মেলাঘরে যান সেসব কাহিনি। আবার কাহিনির আড়ালেও থাকে উপকাহিনি। মুক্তিযুদ্ধের মত সর্বাত্মক তৎপরতার মধ্যেও যে বিভিন্ন পন্থার পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ছিল সেসব স্মৃতিরও চারণা করেন তিনি।
বস্তুত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিচিত্র সব বিষয়ে ছিল তাঁর আগ্রহ। হয়তো সেকারণেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রুশ ভাষা থেকে অনেক মহৎ সাহিত্য অনুবাদ করা সম্ভব হয় না তাঁর পক্ষে। প্রায়ই তিনি বলতেন বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, শব্দাবলি, ব্যবহৃতি এসবের বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি-আশ্রয়ী গ্রন্থের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা দরকার। পরে তাঁর সেই আগ্রহ ও নিবেদনের ফলিত রূপটি দেখতে পাই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার নিয়ম কানুন ব্যাকরণ ইত্যাদি বিষয়ের গ্রন্থাবলিতে তাঁর সম্পৃক্ততায়। শিক্ষার্থীদের জন্যে যথেষ্ট ভাবতেন তিনি। কীভাবে সাধারণ ও ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে সেসব বিষয়ে উদ্ভাবনাপূর্ণ ভাবনা তিনি ভাগাভাগি করতেন আমাদের সঙ্গে। দেখেছি জাতীয় কবি নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনী বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে ভাবিত। তাঁকে জিজ্ঞ্যেস করি, নজরুলের ওপর এত গ্রন্থ, তারপরও নজরুল কেন! একই কথা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও প্রযোজ্য। তাঁর উত্তর—এত গ্রন্থ কিন্তু একটি প্রামাণ্য গ্রন্থে নজরুলের বিশাল জীবন ও কর্মের সালতামামি সংরক্ষণ করতে পারলে সেটা কাজে লাগবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। সেই চেতনা থেকেই নজরুল এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়ক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন নিদারুণ পরিশ্রম করে। আমরা কৌতুক করে বলতাম, মাহবুব ভাইয়ের সব কাজই তাঁর হস্তাক্ষরের মত নিখুঁত। তাঁর অসাধারণ নান্দনিক হস্তাক্ষর ছিল প্রবাদপ্রতিম। তাঁর প্রয়াণ তাঁর অনেক আরাধ্য কাজের আকস্মিক যতিপাত ঘটিয়েছে তা যেমন সত্য তেমনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিজগতও হারিয়েছে একজন মানবিক বোধের পরিপোষক মানুষকে।
২৫ জুলাই ২০২৪