মো. দিদারুল আলম »
করোনা প্রতিরোধে আমাদের দেশে মাস্ক ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এরপরও সবাই যে মাস্ক পরছেন, তা নয়। কেউ কেউ পরছেন। অনেকেই না জেনে বাজার থেকে নকল মাস্ক কিনে ব্যবহার করছেন। এতে মাস্ক পরেও অনেকেই করোনায় সংক্রমিত হচ্ছেন। এখন বাজারে থাকা মাস্কগুলো করোনা প্রতিরোধে কতটা কার্যকর, তার ওপর একটি গবেষণা করেছেন আমেরিকার ডিউক ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। তাঁরা বলছেন, বাজারে থাকা সব মাস্ক করোনাপ্রতিরোধী নয়।
করোনা সংক্রমণরোধে মাস্ক কি সত্যিই কার্যকর? পরিসংখ্যান বলছে, এ পর্যন্ত যেসব দেশে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেসব দেশে আক্রান্ত ও মৃতের হার উভয় কমেছে। অস্ট্রিয়ার স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, মার্চের শেষ দিকে সেখানে আক্রান্তের হার বেড়ে যায়। তখন গড়ে প্রতি ১০ লাখে ৯০ জন শনাক্ত হলেও, মাস্ক বাধ্যতামূলক করার পর, চলতি মাসে সে সংখ্যা কমে ১০ জনেরও নিচে চলে আসে।
ব্রিটেনের শীর্ষ ১শ চিকিৎসক বাড়িতে তৈরি মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউরোপের চেকপ্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়াও মাস্ক পরা আবশ্যক করে আক্রান্ত ও মৃতের হার কমিয়েছে।
মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করে লকডাউন ছাড়াই ব্যাপক সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান।
আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির মাধ্যমে বেরিয়ে আসা ড্রপলেটের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এই ড্রপলেট নিয়ন্ত্রণ করা গেলে আক্রান্তের হার কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন হাঁচি, কাশির সময় মাস্ক বা অন্য কিছু দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখা। তবে প্রচলিত, মাস্কের গুণাগুণ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
গবেষকদের প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষ হাঁচি, কাশি, গান গাওয়া, চিৎকার করা ও কথা বলার সময় মূলত ড্রপলেট আসে। আর করোনাভাইরাস মূলত ড্রপলেটের মাধ্যমেই বেশি ছড়ায়। করোনায় সংক্রমিত প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ জানেন না, তাঁরা সংক্রমিত হয়েছেন। এ কারণে তাঁরা চিন্তাহীনভাবে ঘুরে বেড়ান। এতে করোনার সংক্রমণ অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। এ কারণেই সবাইকে মাস্ক পরিধান করা উচিত।
ডিউক ইউনিভার্সিটির ফিজিশিয়ান ও গবেষক দলের সদস্য এরিক ওয়েস্টম্যান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যদি সবাই মাস্ক ব্যবহার করে, তাহলে মানুষের ড্রপলেট থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর হার ৯৯ শতাংশ বন্ধ করা সম্ভব। ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আসার আগ পর্যন্ত প্রমাণিত যে, এভাবেই নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে হবে।’ গবেষক দলের সদস্য ডিউক ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট ও ফিজিসিস্ট মার্টিন ফিসার বলেছেন, ‘আমরা সবাইকে মাস্ক পরার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছি। তবে যেনতেন মাস্ক নয়, যেসব মাস্ক কার্যকর, কেবল সেসব মাস্কই পরতে হবে।’
২০১৬ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, একজন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করেন। তাই করোনা সংক্রমণ রোধে নিয়মিত হাতধোয়া এবং মুখে মাস্ক পরার ওপর এত জোর দেওয়া। তাছাড়া, মাস্ক পরলেই হবে না, সেটা থেকে উপকার পেতে হলে জানতে হবে ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি। কোনো ধরনের মাস্ক পরলে উপকার পাওয়া যাবে। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় অন্তর মাস্ক বদলাতে হয়। এবং এগুলো যেখানে সেখানে ফেলা যাবে না।
আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে সরকারি নির্দেশ মেনে কেবল মাস্ক পরলেই চলবে না, জানতে হবে আদৌ তা কাজে লাগছে কি না। অনেকেই সরকারি নির্দেশের চাপে পড়ে একটা মাস্ক মুখে জড়িয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। কেউ কেউ আবার মুখের বদলে গলায় মাদুলির মতো মাস্ক ঝুলিয়ে দিন কাটিয়ে দেন। কিন্তু এতে লাভ কিছু হচ্ছে না। বরং নিজের অজান্তেই নিজের এবং অন্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
যেখানে আমরা সামাজিক দূরত্ব এবং লকডাউন নিজেরা অর্থনৈতিক কারণে পুরোপুরি মেনে চলতে পারছি না, নিয়মিত হারে যেখানে নতুন রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ মানুষের সবার মাস্ক পরা উচিত। অন্তত কাপড়ের মাস্ক সবাইকে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষ করে জনসমাগম হওয়া স্থানগুলো যেমন, হাটবাজার, রাস্তাাঘাট, বাস-ট্রেনসহ অন্যান্য গণ-পরিবহনে কোনোভাবেই মাস্ক ছাড়া যাওয়া যাবে না।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন সাবান-পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকার বিষয়গুলো আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, জনগণের নাগরিক দায়িত্ব ও সচেতনতাই বড় রক্ষাকবচ।
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাস্তা ঘাটে বের হলে দেখা যায় অনেকেই মাস্ক ব্যবহার করছে না। এখন সবাইকে বুঝতে হবে, করোনার যথাযথ ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত মাস্কই হলো ভ্যাকসিন। মাস্ক শুধু নিজেকে রক্ষা করে না, আশেপাশের লোকদেরকেও সমান রক্ষা করে। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা যেহেতু তেমন উন্নত নয়, তাই আমাদের সকলের উচিত যথাযথ নিয়ম মেনে মাস্ক পরিধান করা। সরকারের উচিৎ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা এবং জনগণ যাতে মাস্ক ব্যবহারে আগ্রহী হয় সে ব্যাপারে ব্যাপক কাজ করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক