সম্প্রীতি বুনন’ প্রকল্পের আওতায় ডায়ালগ
নিজস্ব প্রতিবেদক »
“অন্ধ আত্মস্বার্থপরতা মানুষের মনুষ্যত্বকে পেছনে ফেলে পশুত্বকে অগ্রগামী করে। ব্যক্তি তখন নিজেকেই সঠিক আর অন্যকে বেঠিক মনে করতে থাকে। এমন অবস্থায় ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির স্বার্থের সংঘাত শুরু হয়, যুক্তিবোধ হয়ে পড়ে অসহায়। এতে সমাজে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। মানুষ হয়ে ওঠে মানুুষের শত্রু। অনিরাপত্তা তখন সমস্ত সমাজকে গ্রাস করে। যদিও ধর্ম তখন মানুষকে শান্তির পথে আহবান করে, কিš‘ যুক্তিহারা মানুষ ধর্মকেও নিজের স্বার্থের হাতিয়ার বানায়। শুরু হয় চরম হানাহানি, সংঘাত, সহিংসতা আর অশান্তি! আশার কথা হলো, মানুষ অশান্ত সমাজে দ্রুতই অসহনীয় হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে শুভবোধ জাগ্রত হয়। প্রকৃতিগতভাবেই এই বোধ মানুষকে নিরাপত্তার পথে তাড়না যোগায়, শান্তির বারতা দেয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতায় একটি প্রেমময় ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের প্রেরণা হয়ে সামনে দাঁড়ায় সেই অবদমিত বুদ্ধিবৃত্তি। তবে, মানুষের সেই অন্তর্নিহিত শুভত্বকে জাগাতে হয় শুভত্ব দিয়ে। শান্তি স্থাপনে সম্প্রীতির চাষাবাদ তাই অপরিহার্য।”
‘কালটিভেশন অফ সেক্যুলার মাইনড’ অর্থাৎ ‘সম্প্রীতি বুনন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ‘ডায়ালগ’ প্রোগ্রামে উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিশনিবার চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারি হলে এ ‘ডায়ালগ’ অনুষ্ঠিত হয়।
কর্মশালায় বক্তব্য উপস্থাপন করেনচট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের (চবি) কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর ড. মো. সেকান্দর চৌধুরী, চবি চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন,চবিআধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর মনজুরুল আলম ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক সুভাষ দে।
‘সম্প্রীতি বুনন’ শীর্ষক প্রকল্পের নেতৃত্বদানকারী চবি দর্শন বিভাগের শিক্ষক মাছুম আহমেদ অনুষ্ঠানে ‘ডায়ালগ’ শীর্ষক মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন। তিনি সহনশীল সমাজ বিনির্মাণে ‘ডায়ালগ’ এর গুরুত্ব উপস্থাপন করেন। প্রকল্পের পরিচালক শান্তিকর্মী সনৎ কুমার বড়ুয়া ও শাসনবড়ুয়া কর্মশালায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন। কর্মশালায়আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিষয়ে প্রকল্পের আওতায় অনুষ্ঠিত নানা কর্মকা-ের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র উপস্থাপন করা হয়।
কর্মশালায় প্রফেসর ড. মো.সেকান্দর চৌধুরী বলেন, ‘সম্প্রীতি বুনন আমাদের কেন করতে হ”েছ? কারণ আমাদের কোনো কোনো জায়গায় সম্প্রীতিতে ব্যাঘাত ঘটেছে। কিš‘ এটা এমনটা কথা ছিল না। দুইশ বছর আগে ডিরোজিও কিংবা একশ বছর আগে দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাশ এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায় সম্প্রীতির যেই বীজ রোপিত হয়েছে আমরা সেই বাগানের পরিচর্যা করতে পারিনি। অপরাজনীতির প্রতিফলন আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে ঢুকেছে। সেটি থেকে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হ এবং আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হচ্ছে।’
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘শিক্ষা যদি সঠিকভাবে হয় তাহলে ধর্ম কখনো সম্প্রীতিতে বাধা হতে পারে না। এটিই হ”েছ আমাদের বড় জায়গা। আমরা যখন সঠিক শিক্ষা দান করতে পারব, সম্প্রীতিময় সমাজ গঠন তখন সহজতর হবে। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে যাচ্ছে, যখন সবকিছুতে সমৃদ্ধি লাভ করবে তখন সংকুচিত জায়গাগুলো কমে আসবে। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, আলো আমাদের আসবেই।’
প্রফেসর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, আমরা প্রত্যেকে যদি মানবিক কাজে নিয়োজিত হই কিংবা মানবিক কাজের সহযোগী হই তবেইসম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। তিনি সমাজের অনগ্রসরদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সকলকে আহবান জানান।
প্রফেসর মনজুরুল আলম বলেন, শিশুর মানস গঠনে পরিবারের ভূমিকা অনন্য। তিনি অভিভাবকদেরকে সন্তানের মানবিক মানস গঠনের কারিগর হিসেবে আখ্যায়িত করে নতুন প্রজন্মকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথে আহবান জানান।
সাংবাদিক সুভাষ দে আত্মস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে অপরাপর মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত হবার আহবান জানান। এক্ষেত্রে তিনি মহান ব্যক্তিদের রেফারেন্স তুলে ধরেন।
মহান ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং সর্বজনীন প্রার্থনার মধ্যদিয়ে কর্মসূচি শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সম্প্রীতিমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করেন প্রকল্পের গবেষণা সহকারী প্রার্থী ঘোষ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন শান্তিকর্মীফাতেমা আকতার।অনুষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী তথা শান্তিকর্মীসহ প্রায় ৫০ জন তাঁদের মতামত তুলে ধরেন। তাঁরা প্রত্যেকেই প্রাণ খুলে কথা বলেন এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বিনির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।তাঁরা বলেন, ‘স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে আমাদের সকলকে মিলে সমাজকে শক্তিশালী করতে হবে। সমাজ ও পরিবারকে শক্তিশালী করতে পারলেই সম্প্রীতির ভিত শক্ত হবে। আমরা সাম্প্রদায়িকতার বৃক্ষ চাই না। কাজের মাধ্যমে আমরা সম্প্রীতির বৃক্ষ রচনা করতে চাই, সম্প্রীতির বীজ বপন করতে চাই।
উল্লেখ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নেটওয়ার্ক ফর রেলিজিয়াস অ্যান্ড ট্র্যাডিশনাল পিসমেকার্সসহ কয়েকটি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সম্প্রীতি বুনন’ শীর্ষক গবেষণা প্রকল্পটি চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন হচ্ছে।