বাংলাদেশে সুযোগ পেলেই দুইনম্বরি কারবারিরা তৎপর হয়ে ওঠে। সেটি রমজান বা ঈদ হোক কিংবা মহামারি হোক। যেকোনো পণ্য এরা ভেজাল করে তা জীবনরক্ষাকারী ওষুধ বা বর্তমান সময়ে অতি প্রয়োজনীয় জীবনরক্ষাকারী অক্সিজেন হোক না কেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তারের মধ্যে বাজারে হঠাৎ অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশি দামে বিক্রি করলেও সিলিন্ডারগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসনের নিয়মিত অভিযানে উঠে আসছে ভয়াবহ চিত্র।
বুধবার (১০ জুন) বেলা সাড়ে ১১টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গালিব চৌধুরীর নেতৃত্বে নগরীর আন্দরকিল্লা মোড় ও এনায়েত বাজারে ভ্রাম্যামাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
অভিযানে নগরীর এনায়েত বাজার এলাকার বিসমিল্লাহ মেরিন স্টোর নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ১ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা এবং আন্দরকিল্লা মোড়ের এবি সার্জিক্যালকে অধিক মূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডার বিক্রি করায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গালিব চৌধুরী সুপ্রভাতকে বলেন, করোনার সংকটের মধ্যে গুণগত মানসম্পন্ন অক্সিজেন সিলিন্ডার ন্যায্যমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিতে অভিযান পরিচালিত হয়। অক্সিজেন সিলিন্ডার দুই ধরনের হয়ে থাকে- ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড ও মেডিক্যাল গ্রেড। মুমূর্ষু রোগীদের জন্য ব্যবহৃত অক্সিজেন প্রায় শতভাগ বিশুদ্ধ হতে হয়, যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেড অক্সিজেন সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয় না। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জাহাজ থেকে পাওয়া মানহীন সিলিন্ডারগুলোতেও কোনোরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অক্সিজেন রিফিলিং করছে এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে বিপুল মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক-কর্মচারী অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানির কোন ধরনের ইনভয়েস ও প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। নিজেদের মতো করে দাম বৃদ্ধি করে বিক্রয় করে আসছে এসব মানহীন অক্সিজেন সিলিন্ডার। প্রতিষ্ঠানটির ফায়ার এক্সটিংগুইশার আমদানির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকলেও অক্সিজেন সিলিন্ডার আমদানি ও মজুদের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তর প্রদত্ত লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাগজপত্র নেইচট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন স্থানে মেডিক্যাল অক্সিজেনের নামে বিক্রি হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন সিলিন্ডার। শিল্পকারখানার এ অক্সিজেন ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ঝালাইয়ের কাজে। কিন্তু এটি মেডিক্যাল অক্সিজেন নামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে।
অভিজ্ঞজনদের মতে, দুই অক্সিজেনের পার্থক্য হলো কেবল পরিশোধন বিশুদ্ধতায়। কিন্তু বাজারে বিক্রি হওয়া ধাতব লোহার তৈরি সাদা-কালো রঙয়ের পাত্রের সিলিন্ডারের চেহারা দেখে মানুষের পক্ষে বোঝার কোনো উপায় নেই এটা কি মেডিক্যাল নাকি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন!
মেডিক্যাল ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের তফাৎ
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো. আব্দুল হান্নান জানান, মেডিক্যাল ও ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের উৎপাদন ও পরিশোধন পদ্ধতি ভিন্ন। মেডিক্যাল অক্সিজেন পরিশোধনে বিশুদ্ধতার মাত্রা থাকে ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশের উপরে। ০.৫ শতাংশের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও পানির মিশ্রণ থাকে। আর ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন পরিশোধনে বিশুদ্ধতার মাত্রা ৯০ শতাংশের নিচে থাকে। এই অক্সিজেনের সাথে বায়ুমণ্ডলের অন্যান্য গ্যাসের মিশ্রণের মাত্রা থাকে বেশি।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হারুনুর রশিদ বলেন, মেডিক্যাল অক্সিজেনের মধ্যে কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও পানির মিশ্রণের মাত্রা একেবারে কম বিধায় তা শরীরের জন্য সহনীয়। কিন্তু ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের বিশুদ্ধতার মাত্রা অনেক কম থাকে। এতে বায়ুমণ্ডলের অন্যান্য গ্যাসের মাত্রার পরিমাণ বেশি থাকে বিধায় তা শরীরের জন্য অসহনীয়। এসব গ্যাস শরীরের রক্ত, ফুসফুস ও ব্রেইনসহ বিভিন্ন কোষকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।
কিন্তু সাধারণ মানুষ এতকিছু বোঝে না। এদের মধ্যে অনেকে আতঙ্কিত হয়ে আগেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ঘরে মজুদ করে রাখছেন। এতে বিপদের আশঙ্কা বাড়ছে। অদক্ষভাবে সিলিন্ডার ব্যবহার করতে গিয়ে বিস্ফোরণের ঝুঁকি ছাড়াও কোন রোগীকে কতটুকু অক্সিজেন দিতে হবে তা না জানায় রোগীর জন্য তা মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
কাজেই অক্সিজেন সিলিন্ডার কেনা-বেচার ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ যত তাড়াতাড়ি তৎপর হবে ততই মঙ্গল হবে।