১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন।
তাঁর প্রতি আমাদের অতল শ্রদ্ধা
কামরুল হাসান বাদল »
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি কেন? প্রশ্নটি সঙ্গত। অনুসন্ধিৎসু ও সময়ের দর্পণে অনিবার্যও বটে। জাতীয় কবি তো তিনিই হবেন, যিনি তাঁর কাব্যে, সঙ্গীতে, সামগ্রিক সাহিত্য ও চেতনায় একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, দ্রোহ ও প্রেমকে ধারণ করবেন। কোলকাতার বর্ধমানের চুরুলিয়ায় একটি সাধারণ পরিবারে জন্ম-নেওয়া নজরুলই একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ থেকে অসাধারণে পরিণত হয়ে এই ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের কথাই বলে গেছেন অসাধারণভাবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো সর্বপ্লাবী প্রতিভার ছায়ায় বেড়ে ওঠা অনন্য প্রতিভা তিনি। বিশ্বকবির সমসাময়িক অনেকেই যখন তাঁর অনুকরণ, অনুসরণ ও প্রভাবে প্রায় স্বকীয়তাহীন সে-সময় নজরুল উপস্থিত হলেন সম্পূর্ণ অন্য ভাষায়, অন্য সুরে, অন্য রূপে। নিজের সম্পর্কে আগে পাঠকদের জানান দেন ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’ অর্থাৎ একাধারে তিনি প্রেম ও দ্রোহের কবি। কিন্তু শুধু কি তাই? প্রেমের জন্য হাহাকার ছিল বটে, বিদ্রোহের জন্য তৃষ্ণা ছিল বটে কিন্তু সব ছাপিয়ে নজরুল মানুষের, মানবতার, সাম্য ও সম্প্রীতির কবি।
একটি পরাধীন দেশে জন্ম নজরুলের। জন্মেই মুখোমুখি হয়েছেন দারিদ্র, কুসংস্কার আর মানবতার অপমানের। যে-কারণে যে কোনোভাবে তাঁর কবিতায় মানবমুক্তির কথা, অধিকারের কথা আর ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ঘোষিত হয়েছে। মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে তিনি এর মধ্যে যে-গোঁড়ামি দেখেছেন, যে-কূপমন্ডূকতা দেখেছেন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। মানুষ, একমাত্র মানুষই হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে সবার ঊর্ধ্বে। তাঁর কণ্ঠে তাই উচ্চারিত হয়েছে,
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।’
নজরুল কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের, নির্দিষ্ট জাতি ও নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের নন। তিনি সর্বকালের, সর্বদেশের এবং সব মানুষের। নজরুলের আগে বিশ্বের কোনো কবি এভাবে বলেছেন বলে জানা যায়নি।
‘মানুষেরে ঘৃণা করি
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি।
ঐ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেড়ে
যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মুর্খরা সব শোনো মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।’
নজরুলকে অনেকে মানবধর্মের নবী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আজকে যারা নজরুলকে খণ্ডিতভাবে উপস্থাপন করে শুধু একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমিত রাখতে চান, তাদের বিরুদ্ধেই নজরুল আজীবন কলম ধরেছেন, বিদ্রোহ করেছেন। এই শক্তিই একদিন নজরুলকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল। তাঁকে আক্রমণ করেছিল। নজরুল যে শুধু অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তা শুধু নয়, তিনি ছিলেন সাম্যেরও কবি। সাম্যবাদী কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।
মিথ্যা শুনিনি ভাই
এ হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির কাবা নাই।’
সমাজের অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষকে নিয়ে তিনি লিখলেন,
‘দেখিনু সেদিন রেলে
কুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে
চোখ ফেটে এল জল
এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
নজরুল বুঝেছিলেন সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার না থাকলে, নারীদের জাগরণ ঘটাতে না পারলে একটি জাতির এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
নজরুল তার লেখায়, চিন্তায়, সৃষ্টি ও ধ্বংসে বারবার একটি স্বদেশের চিত্র এঁকেছেন। তার সে-স্বদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণ ও বঞ্চনাহীন। যে-স্বদেশ হবে সব মানুষের।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নজরুলের স্বপ্নের সে-দেশই প্রতিষ্ঠিত হলো। এই দেশের সংবিধানে সন্নিবেশিত হলো গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন, এমন একটি সমাজব্যবস্থার জন্য যিনি লড়াই করেছিলেন সে রাষ্ট্রের জাতীয় কবি তো নজরুলই হবেন।
নজরুল বাঙালি মুসলিমদের প্রকৃতপক্ষে ঘুম ভাঙিয়েছিলেন। কবিতায় শুধু নয় সঙ্গীতেও এক প্রবল জোয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। বাংলা আধুনিক গান পূর্ণতা পেয়েছিল তার কণ্ঠেই। কথা ও সুরের বৈচিত্র্যের জন্যই শুধু নয় মুসলমানদের সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টিতে তার অবদান মহান ও অনস্বীকার্য। কবিতা, গান ছাড়াও শিশুসাহিত্য, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি সমৃদ্ধ করেছে আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে।
গত শতকের এই সময়ের কাছাকাছি নজরুল তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিলেন। বিদ্রোহ করেছিলেন মৌলবাদ, কুসংস্কার, শোষণ ও মানবতার অপমানের বিরুদ্ধে। আজ এত বছর পরেও তাঁর স্বপ্নের দেশে আজ আমরা নতুন করে সে-অপশক্তির মুখোমুখি। সেই সাম্প্রদায়িকতা, সেই মুর্খতা, সেই অমানবিকতা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
তাই আজ জাতীয় কবির প্রতি বিনম্রভাবে প্রশ্ন রাখতে ইচ্ছে করে, ‘তোমার যা বলার ছিল, বলছে কী তা বাংলাদেশ?’