অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ »
২০১১/১২ সালের কোনো একসময়ে চট্টগ্রাম যেতে হবে ইউআইটিএসএর সিন্ডিকেট সভায়, যার আমি সরকার মনোনীত প্রতিনিধি। যাহোক, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেবের সঙ্গে আগে কোনোদিন পরিচয় ঘটেনি। কর্পোরেট ভবনে তার অফিসে দেখা। একজন অনতিদীর্ঘদেহী মানুষকে টেবিলের দুইপাশে রাখা বইয়ের স্তূপের মধ্যে বেশ ছোটই লাগছিল। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন প্রথম দর্শনে। আমি বেশ অবাক! একজন মানুষকে কখনো দেখিনি, তাকে কীভাবে আমি এত দ্রুত একেবারেই বুকে জড়িয়ে ধরব। তারপর যতই তার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হলো আন্তরিকতার ছাপ ততই স্পষ্ট হয়ে উঠল, কোনো কিছুতেই কৃত্রিমতা নেই, একেবারেই নির্ভেজাল। একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র উদ্বোধনের পালা; সকলেই জড়ো হচ্ছি। আমি মনে মনে ভাবছি আমাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে তিনি উদ্বোধন করবেন। আবার ভাবছি এমন বিনয়ী মাটির মানুষ নিশ্চয়ই নিজে উদ্বোধন না করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপককে দিয়েই কাজটি করাবেন। একজন পরিছন্নকর্মীকে মা বলে সম্বোধন করে কাছে ডাকলেন এবং তাকে দিয়ে উদ্বোধন করালেন। আমি নির্বাক!
সিন্ডিকেট সভায় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণীতে সভার সিদ্ধান্তের গুরুত্বের কথা বললেন। তবে বিনয়ের সঙ্গে একথাটিও জানালেন যে, এদেশের ছেলেমেয়েরা যাতে তুলনামূলকভাবে কম ফি’তে পড়তে পারে এ জন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাই ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই যেন তার মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে যেখানে ‘অলাভজনক’ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অন্য যেকোনো ব্যবসা থেকে কম লোভনীয় নয়, যার দরুণ যারা জীবনেও পড়ালেখার ধারেপাশে নেই তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য এত তৎপর, সেখানে ছাত্রদের বেতনবৃদ্ধিতে আপত্তি। উপরন্তু শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এখনো পিএইচপি গ্রুপকে অনুদান দিতে হয়। সেক্ষেত্রে বেতনবৃদ্ধিতে অনীহায় অবশ্যই তার শিক্ষানুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সদালাপী, নিরহংকার মানুষটি সুবক্তাও বটেন, তাও আবার বিভিন্ন ভাষায়। বাংলা, ইংরেজি কিংবা ফারসি সমান দক্ষতায় সাবলীলভাবে দীর্ঘক্ষণ মানবতার বাণী শোনাতে পারেন, নানাবর্ণের নানাধর্মের ও নানাকালের বিভিন্ন মহাপুরুষের গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ, কবিতা, গান অবলীলায় যথাযোগ্য প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করে তার বক্তব্য শানিত ও হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন। যখন কথাগুলো উচ্চারণ করেন তখন মনে হয়, হৃদয়ে ধারণ করা কথাগুলোই মুখ দিয়ে বের হচ্ছে, কোনো কৃত্রিমতা নেই। খাওয়ার সময় কাছে এসে নিজ হাতে খাবার তুলে দেবেন নিজে অবশ্য বেশিরভাগ সময়ে রোজা রেখেই। নাতি-নাতনিদেরও ভালো মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আমাদের সামনে নিয়ে এলেন এবং তারা অনেক নীতিকথা প্রাণ দিয়ে উচ্চারণ করল। তার ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত এবং আমার সন্দেহ নেই যে তারা উন্নত নীতিবান মানুষও। রাতে গজলের আসর বসল। যারা গাইলেন তাদের যোগ্য সম্মানী দিলেন। এভাবে বাংলাদেশে গজলের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছেন সুফি মিজানুর রহমান।
আমি কৃপণ মানুষ; বিমানবন্দরে যাতায়াতের জন্য যথাসম্ভব নিজস্ব যানবাহন ব্যবহার এড়িয়ে চলি, বিশেষত একা যদি থাকি। একদিন চট্টগ্রাম থেকে ফিরছি। সুফি সাহেবের সঙ্গে বিমানে দেখা। তিনি প্রথমেই বললেন, তার সঙ্গে যেতে হবে। তার গাড়িতে যাচ্ছি। পথে গাড়িচালককে বললেন, ফলের দোকানে নিয়ে যেতে, তার ভগ্নীর জন্য ফল কিনতে হবে। যাহোক, পথে নেমে আমাকে গাড়ি ছেড়ে দিলেন ফলের ঝুড়িসহ। তখন টের পেলাম যে আমার স্ত্রী তার ভগ্নি। এভাবে মানুষকে এত সহজে আপন করে নিতে পারে কেবল বিশাল হৃদয় মানুষ। এখানে বলতেই হয়। তাঁর সঙ্গে আমার স্ত্রীর সাক্ষাতের কোনো সুযোগই হয়নি। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াড কমিটির মাধ্যমে আমরা ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য প্রেরণ করি। মিজান ভাই অর্থায়নের সমস্যা অনুধাবন করে বেশ কয়েক বছর তার অর্থায়ন করেন। মুক্তহস্তে দান করেন। সবাইকে জানাতে ভোলেন না যে তিনি ১০০ টাকা মাসিক বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এবং সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণও করেননি। তাঁর জীবনের ইতিহাস সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার ইতিহাস, যা সকলকেই উদ্বুদ্ধ করবে।
ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতের বিদায় সংবর্ধনা জানাতে গুলশানে একটি হোটেলে বড়ো আয়োজন করেছেন। সেখানে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত এবং সম্ভবত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত তাকে রীতিমতো পিতা বলে সম্বোধন করলেন। একটি দেশের এটা যে কত বড়ো প্রাপ্তি একজন মানুষ অন্য দেশের একাধিক রাষ্ট্রদূতের থেকে যে সম্মান পেয়েছেন সেই সম্মানটি আমাদের দেশের। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনন্য সকল ব্যক্তিত্বকে। একবার নিয়ে এলেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করার এরকম প্রচেষ্টার কোন জুড়ি নেই। ২০১৪ সালে নিয়ে আসলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদকে এমন সময়, যখন বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল, সর্বত্র অনিশ্চয়তা। কিন্তু নিশ্চয়ই সুফি মিজানুর রহমানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়নি প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতার। সুফি সাহেবের বক্তব্য এতই হৃদয়গ্রাহী, শক্তিশালী। ওই সময়ে মাহাথির মোহাম্মদের আগমন নিশ্চয়ই আমাদের দেশের ভাবমূর্তিতে একটি বড়ো অবদান রেখেছে। আমি নিশ্চিত দেশ-বিদেশে তার উপস্থিতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ঠিক একইভাবে উজ্জ্বল করছে।
চট্টগ্রাম থেকে একই সঙ্গে বিমানে আসছি। যথারীতি আমাকে আগে নামার অপেক্ষা করলেন, আমি তাঁর থেকে বয়সে একযুগ কম হলেও। তারপর বাসে করে টার্মিনালে আসতে হবে। বাসে উঠে দুজনই বসার জায়গা পেলাম। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে এক মধ্যবয়সী মহিলাকে বসার জায়গা করতে যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ালেন। অন্যের জন্য নিজের আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে কখনো তাঁকে হিসাব নিকাশ করতে হয় না। অন্যের থেকে যেকোন প্রাপ্তিকেই মহামূল্যবান, নিজে লক্ষ টাকা দিলেও তাকে চরণধূলিসম মনে করেন এবং দেওয়াটা সবসময়ই গোপনীয়তা বজায় রেখেইে করেন।
আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৮১ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দেশের প্রয়োজনে অবসরের ১৫ বছর পর ২০১৮ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী হন ৯৩ বছর বয়সে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ২০২০ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সুফি মিজানুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল। বিক্ষিপ্ত মানসিক অবস্থার মধ্যেও তিনি দেখা করেছেন। মুসলিম জাহানের সবচেয়ে সফল নেতার কাছে সুফি মিজানুর রহমানের অবস্থান কতই না উঁচুতে, যদিও তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো পদ অধিকার করে নেই।
২০টির বেশি কোম্পানি সমৃদ্ধ গ্রুপের নাম দিয়েছেন ‘পিএইচপি’ শান্তি, সুখ, সমৃদ্ধির ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর দিয়ে। তাঁর কোনো এক কোম্পানির একজন কর্মকর্তা দৃষ্টিশক্তি হারালেন। তাকে অনেক বেশি সুযোগসুবিধা দিয়ে তার চলাচলকে নির্বিঘ্ন করে চাকুরিতে বহাল রেখেছেন।
সুখের বিষয় এই যে, এই মানবতার সেবক, সমাজসেবককে বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে একুশে পদকে ভূষিত করেছেন। বাংলাদেশ সরকারকেও অভিনন্দন জানাই, অভিনন্দন জানাই আমাদের দেশকে এরকম একজন সূর্যসন্তান ধারণ করার জন্য। কামনা করি তিনি আরো অনেক বছর সারাদেশে শান্তির বাণী, মানবতার বাণী শোনাবেন, দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে আমাদের দেশগড়ায় বড়ো অবদান রাখবেন।
লেখক : অধ্যাপক, বুয়েট