মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হবে

সম্প্রতি একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কয়েক বছরের ধারাবাহিক অগ্রগতির পর গত দুই বছরে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে শিশুমৃত্যুর হারও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর বড় কারণ বাল্য ও কিশোরী বিয়ে। অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের কারণে সন্তান প্রসব করার সময় রক্তক্ষরণ বেশি হয়, যে কারণে তাদের মৃত্যুর হার বেশি। এছাড়া কিশোরী মায়েদের বিভিন্ন সমস্যার প্রভাব শিশুর স্বাস্থ্যের ওপরও পড়ে। ফলে শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, এখনো বিশ্বে প্রতি বছর তিন লাখ নারী গর্ভাবস্থায় বা প্রসবের পর পরই মারা যান। বছরে ২০ লাখ শিশু জন্মের প্রথম মাসেই মারা যায়। আর মৃত শিশু জন্ম নেয় ২০ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৭ সেকেন্ডে একটি এমন শিশু মারা যায়, যার মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মেটারনাল অ্যান্ড পেরিনেটাল ডেথ সার্ভিলেন্স অ্যান্ড রেসপন্সের (এমপিডিএসআর) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ধারাবাহিকভাবে মাতৃমৃত্যু কমলেও গত দুই বছর আবার বাড়তে শুরু করেছে। ২০২২ সালে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু হার ছিল ৬২ জন। ২০২৩ সালে এ সংখ্যা ছিল লাখে ৭৫। ২০২৪ সালে তা বেড়ে ৯০-এ পৌঁছেছে। গত বছর মাতৃমৃত্যু সবচেয়ে বেশি ছিল সিলেট বিভাগে। এ বিভাগে লাখে ১১ জন নারী মারা যান।

যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২৩ সালের হিসাব অনুসারে, প্রতি ১ লাখ জীবিত শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মা মারা যান। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১৫৩। ২০২১ সালে মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১৬৮।

নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে কিশোরীদের গর্ভধারণের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। ১৯ বছর বয়সের আগে প্রতি হাজারে ১১৩ কিশোরী গর্ভধারণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোরী অবস্থায় বিয়ে ও গর্ভধারণের হার বেড়ে যাওয়ায় মাতৃমৃত্যু বা শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে।
অন্যদিকে এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুহার হঠাৎ বেড়ে গেছে। ২০২৩ সালে প্রতি এক হাজার জীবিত নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৬। পাঁচ বছর আগে ছিল ১৫। এছাড়া ২০২৩ সালে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩৩ জন। ২০২২ সালে ছিল ৩১ জন। পাঁচ বছর আগে ছিল আরো কম, ২৮ জন।

২০২৩ সালে ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাল্যবিবাহের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে অষ্টম ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের ওপর পরিচালিত ইউনিসেফের জরিপে দেখা যায়, ৫১ শতাংশ নারীর বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় ৪8 লাখ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু খর্বাকৃতির শিকার। যার অন্যতম কারণ মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণ, ‍শিক্ষা ও পুষ্টির অভাব। বাংলাদেশে ১২ থেকে ৪৯ বছরের নারীদের মধ্যে ১২ শতাংশেরই ওজন তাদের বয়স ও উচ্চতার তুলনায় কম। এছাড়া বাংলাদেশে গর্ভবতী নয় এমন প্রজননক্ষম নারীদের মধ্যে উচ্চমাত্রার পুষ্টিহীনতা রয়েছে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়নি। সমাজে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিয়ে বন্ধে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো শতভাগ কার্যকর হয়নি। ফলে মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা রয়ে গেছে। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে অন্যান্য উন্নয়ন বিফলে যাবে।