মহান স্বাধীনতা দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক »

আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালির শৃঙ্খলমুক্তির দিন। বিশ্ব মানচিত্রে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিন, যেটি ছিল বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র। ১৯৭১ সালের এই দিনের সূচনালগ্নে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাতে এই দেশের জনগণের প্রকৃত মুক্তি ঘটেনি। বরং তৎকালীন পূর্ব বাংলার বুকে ব্রিটিশের পরিবর্তে পাকিস্তানের শাসন-শোষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পাওয়ার মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটে। এর দুবছর পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে হেরে যায় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। এই নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে গণতন্ত্র চর্চার যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল তা দীর্ঘ হলো না সামরিক শাসন জারির কারণে। তবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন জোরদার করে। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অতি দ্রুত এই কর্মসূচি জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পাকিস্তানি শাসকরা আন্দোলনকে স্তিমিত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধুর নামে রাষ্ট্রদ্রোহী ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে বঙ্গবন্ধুকে কারারুদ্ধ করে রাখে। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেয়। সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করে জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন।
২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সৈন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ মানুষ। সম্ভ্রমহারা হয়েছিল প্রায় তিন লাখ নারী। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিল।
আমেরিকার পর দ্বিতীয় রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যা ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল প্রকৃত গণযুদ্ধ। যেখানে দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অংশ নিয়েছিল। এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে।
এরই মধ্যে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তৈরি পোশাকশিল্প ছাড়াও চাল, সবজি, ফল, মাছ উৎপাদনে দেশ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার পাশাপাশি মানুষের প্রকৃত মুক্তি। সে মুক্তি ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে, সে মুক্তি শোষণ ও বঞ্চনা থেকে। তবে সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল জাতি তা এখনো আসেনি। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য কমলেও সমাজে বৈষম্য কমেনি।
দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে এবারও। সোমবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানিয়ে বলা হয়, ২৬ মার্চ ঢাকাসহ সারা দেশে প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে।
সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। বিদেশি কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক–সামাজিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের জনগণ স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
এ ছাড়া জেলা ও উপজেলার স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। দেশের সব বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ ও কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবন এবং ঢাকা শহরে সহজে দৃশ্যমান ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। তবে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাতে আলোকসজ্জা করা হয়নি এবার।
ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হবে। ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি থাকবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা বাণী দিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র, নিবন্ধ ও সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ফুটবল, টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট, কাবাডি, হাডুডু ইত্যাদি খেলার আয়োজন করা হবে।
এ ছাড়া মহানগর, জেলা ও উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করবে।
সরকারি বার্তা সংস্থা বাসসের বরাতে বলা হয়েছে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। দেশের সব হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু পরিবার, বৃদ্ধাশ্রম, ভবঘুরে প্রতিষ্ঠান ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হবে।
দেশের সব শিশুপার্ক ও জাদুঘর বিনা টিকিটে উন্মুক্ত রাখা হবে। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর এবং ঢাকার সদরঘাট, নারায়ণগঞ্জের পাগলা, বরিশাল ও চাঁদপুরের বিআইডব্লিউটিএ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো এদিন সকাল ৯টা হতে বেলা ২টা পর্যন্ত জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ কর্মসূচি পালন করা হবে।