মাছুম আহমেদ »
১৯৪৪ সালের কথা, উইনসটন চার্চিল তখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দলের সংসদ সদস্য হ্যারলড্ নিকলসন একদিন দেখলেন স্টেশনের টয়লেটের দরজায় অংকন করে লেখা হয়েছে ‘উইনসটন চার্চিল ইজ এ বাসটার্ড’। অর্থাৎ চার্চিলকে জারজ সন্তান হিসেবে কটাক্ষ করা হয়েছে। অথচ এই চার্চিলের দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জার্মান বাহিনী পরাস্ত হয়। এমপি হ্যারলড নিকলসন মনে খুব কষ্ট পেলেন। কথাটি চার্চিলের কানেও পৌঁছল। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিলেন যারা এমন ‘অপকর্ম’ করেছে তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। চার্চিল সেই পথে গেলেন না। তিনি বললেন, কারা এমন কথা লিখেছে সেটি বড় কথা নয়, কিন্তু ‘আমাকে এমনটি কেন বলা হচ্ছে’ সেটি খতিয়ে দেখাই অতিব প্রয়োজনীয়।
প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে কীভাবে পরমতসহিষ্ণু আচরণ করতে হয় চার্চিলের এমন বক্তব্যে সেটি সহজেই অনুমেয়। বিপরীতে নিজেদের দিকে তাকালে আমরা আরো সহজে নিজেদের আচরণের অসহিষ্ণুতা টের পাই। বিশেষত আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরমতসহিষ্ণুতার ঘাটতি তীব্রভাবে প্রতিফলিত হয়। এ প্রসঙ্গে ফরাসি সাহিত্যিক ও দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রী (১৯৫৮-১৯৬৯) আন্দ্রে মারলো, যিনি ৭০ বছর বয়সী হয়েও ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু মারলোকে সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পরে ১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল মারলো বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেসময় রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ‘ডক্টরেট অভ্ লিটারেচার’ দেন। ঢাকায় ফিরে তিনি রাতের খাবারে অংশ নেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সফরকালে তিনি চট্টগ্রামেও এসেছিলেন। দেখা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।
যাই হোক, মারলোকে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে রাজশাহী নিয়ে যান অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ (যিনি পরে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন)। সদ্যস্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখনও রাস্তাঘাট পুরোপুরি সুগম হয়ে ওঠেনি। বিজয়ী জাতি চেষ্টা করছে ঘুরে দাঁড়াতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেষ্টা করছেন দেশটিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাজাতে। এমন প্রেক্ষাপট তুলে ধরে যাত্রাপথে গাড়িতে অধ্যাপক সারওয়ার মুরশিদ মারলোকে প্রশ্ন করেন “মুজিব (বঙ্গবন্ধু) পারবেন তো একটি নতুন রাষ্ট্র তৈরি করতে?” উত্তরে মারলো বললেন, “অবশ্যই, যদি না আপনারা শিক্ষিতরা, বুদ্ধিজীবীরা তাঁকে মেরে ফেলেন। এদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা নেতিবাচক সমালোচনায় পটু এবং সময়ের আগেই মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকেন।……ণড়ঁ ধৎব ধ পুহরপধষ ষড়ঃ. উড়হ’ঃ শরষষ যরস ষরশব ড়হব ড়ভ ঃযড়ংব ঃৎরনবং যিড় শরষষ ঃযবরৎ ষবধফবৎং ধহফ বধঃ ঃযবরৎ ভষবংয” (সূত্র: কালের কথা, খান সারওয়ার মুরশিদ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা-২০০১, পৃ. ২৯)।
ইতিহাস মারলোর আশংকাকেই সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়। আমরা আমাদের জাতির পিতাকে, স্বাধীনতার স্থপতিতে নৃশংসভাবে হত্যা করে নিজেদের একটি অসভ্য আর বর্বর হিসেবে বিশে^র দরবারে বার্তা দিলাম। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার। নেতৃত্ব আর অভিভাবকত্ব হারিয়ে স্বাধীন দেশের নির্মাণযাত্রা থমকে গেল। লজ্জিত হলো বাংলাদেশ!
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ আর বুদ্ধিজীবীদের অসহিষ্ণু প্রণোদনার গাঢ়ত্ব কতটা সেটি এককথায় মন্তব্য কঠিন তবে, এদেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি মারলো ঘোষিত “সময়ের আগেই মানুষ সম্পর্কে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকেন” মন্তব্যটি কতটা নিরেট সত্য, সেটি উপলব্ধি ততটা কঠিন নয়। বলাবাহুল্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা আর অসহিষ্ণুতার এ চিত্র আমাদের আশপাশের দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক বটে। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারে নেতৃত্ব নিধনের ইতিহাসও আমরা দেখতে পাই। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট একই দিনে পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টি হলো। এ স্বাধীনতার আগে ও পরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে নেতৃত্ব নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। মায়ানমারের বিতর্কিত নেত্রী অংসান সু চির পিতা জেনারেল অংসান ব্রাশফায়ারে নিহত হন। ১৯৪৮ সালের ৩ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী নিহত হলেন, ১৯৬০ সালে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী সুলেমান বন্দর নায়েক নিহত হন এবং শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসাও নিহত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। একই বছরের ৩ নভেম্বর জেলে জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও আবুল হাসনাত মোহম্মদ কামারুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পাকিস্তানের জিয়াউল হক নিহত হন, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরে বেনজির ভুট্টোকেও হত্যা করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকেও বারংবার হত্যা করার অপচেষ্টা চালানো হয়।
ক্ষমতার লোভ আর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অসহিষ্ণুতাই হয়ত এই বিপুল সংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকা-ের একটি বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে।
এই ভারতীয় উপমহাদেশ আর্য-অনার্য, দ্রাবিড়, চীন, মগ, হুন- দল, মোঘল-পাঠান এবং ব্রিটিশদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। অতঃপর পাকিস্তানের দুঃশাসন হয়ে দীর্ঘ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ১৯৭১ সালে মুক্তি পায় বাংলার মানুষ। বঙ্গবন্ধু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জাতিকে একটি অনন্য সংবিধান উপহার দেন। এই সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এই চার মূলনীতিকে রাষ্ট্র পরিচালনার স্তম্ভ করা হয়। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা, ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মাধ্যমে মানুষকে মানুষ হিসেবে সমান মর্যাদা দেওয়া এবং একইভাবে গণতন্ত্রের মূলনীতির ছায়াতলে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতার কথা ঘোষণা দেওয়া হয়েছে সংবিধানে। বঙ্গবন্ধু সবদিক থেকে একটি সুষম বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। সেখানে সবার বাক স্বাধীনতার অধিকারকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে। আর গণতন্ত্রের অন্যতম সৌন্দর্যই হলো পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভিন্ন মতের প্রতি সহিষ্ণু আচরণ। যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে অন্যের মতামতকে খ-ন করাই গণতন্ত্রের অলংকার। পক্ষান্তরে যুক্তিভীতি আর ক্ষমতাপ্রীতির যাঁতাকলে ভিন্নমতকে শত্রু প্রতিপন্ন করে ব্যক্তিকে নিধনের সংস্কৃতি অগণতান্ত্রিক, অসভ্যতা আর বর্বরতা বৈ কিছুই নয়। আবেগতাড়িত নয়, বরং প্রজ্ঞাপ্রসূত আচরণই একটি সমাজকে ন্যায়নিষ্ঠ ও সভ্য হিসেবে গড়তে পারে। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিস্টটল; আধুনিক কালের লক, রুশো কিংবা সমকালের জন রলস, ডরকিন, অমর্ত্য সেনরা সেকথাই সমস্বরে উচ্চারণ করেছেন।
২০২১ সালে বাংলাদেশ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। এই পাঁচ দশকের পরিক্রমায় পরমত অসহিষ্ণুতায় আমাদের বিকাশ কতটা?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়